মণিপুরে খলনায়ক চানুর প্রেমিক

মানুষকে ভালবেসে, মানবাধিকারের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। এক জন ব্যক্তি মানুষকে ভালবেসে এ বার সেই অনশন ভাঙতে চান তিনি। আর তাতেই তেলে-বেগুন তাঁর সমর্থক-বন্ধু, এমন কী, নিজের মা-ও!

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

ইম্ফল শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৬ ০৩:২৭
Share:

শর্মিলা চানু ও ডেসমন্ড কুটিনহো

মানুষকে ভালবেসে, মানবাধিকারের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। এক জন ব্যক্তি মানুষকে ভালবেসে এ বার সেই অনশন ভাঙতে চান তিনি। আর তাতেই তেলে-বেগুন তাঁর সমর্থক-বন্ধু, এমন কী, নিজের মা-ও!

Advertisement

ইরম শর্মিলা চানু। মণিপুরের এই ‘লৌহমানবী’ আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ভাঙবেন অনশন। গত ১৬ বছর ধরে ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁকে হাসপাতালে বন্দি করে নাক দিয়ে জোর করে রাইলস টিউব পুরে দিয়েছেন সরকারি ডাক্তার। খুলে ফেলেছেন শর্মিলা। ফের আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ভাবেই চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম অনশন-পর্ব।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভারতের যে সব রাজ্যে আফস্পা জারি রয়েছে (যেমন কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বের কয়েকটি রাজ্য), সেখানেও যা খুশি তাই করতে পারবে না সেনাবাহিনী। তারপরেই ২৭ জুলাই আদালতে দাঁড়িয়ে শর্মিলা আচমকা ঘোষণা করেন, ৯ অগস্ট অনশন ভাঙবেন তিনি। তার পর বিয়ে করে প্রেমিকের সঙ্গে ঘরও বাঁধতে চান তিনি, জানান ৪৪ বছরের শর্মিলা।

Advertisement

যে শর্মিলার নাকে নল লাগানো ছবি হয়ে উঠেছিল উত্তর-পূর্বের আন্দোলনের মুখ, তাঁর এ হেন ‘সাধারণ’ চাওয়া-পাওয়াই মেনে নিতে এখন অসুবিধে হচ্ছে মণিপুরের। তাই ছাত্রী থেকে সমাজকর্মী, মুদিখানার মালিক বা সরকারি কর্মী, সকলের মুখেই প্রশ্ন— ‘আফস্পা’ বদলানো না-হলেও কেন অনশন ভাঙতে চান চানু? কেন তিনি বিয়ে করতে চান আর পাঁচটা ‘সাধারণ’ মেয়ের মতো? কেন নামতে চান ভোট-ময়দানে?

উত্তর খুঁজতে নেমে সকলেই আঙুল তুলছেন শর্মিলার প্রেমিক ডেসমন্ড কুটিনহোর দিকে। গোয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মানবাধিকার কর্মী ও লেখক ডেসমন্ড শর্মিলার ‘অন্ধ ভক্ত’। তাঁদের সম্পর্ক বেশ কয়েক বছরের। ডেসমন্ডই চিঠির পরে চিঠি লিখে লৌহমানবীর মন গলিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৯ মার্চ দেখা হয় তাঁদের। তখন এক সাক্ষাৎকারে ডেসমন্ড বলেছিলেন, ‘‘আমি জানি, এই মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্ক চালানো আমার পক্ষে খুবই কঠিন হবে। যেমন কঠিন কাজ করতে হয়েছিল গাঁধীর স্ত্রী কস্তুরবা বা জন লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনোকে।’’ প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি ছিল ইরমের সমর্থকদের। এমন কী, এই সমর্থকদের হাতে ডেসমন্ড মার খেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ইরম নিজেই। তখন আদালত ডেসমন্ডের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেয়।

আর এখন অনশন তুলে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে শর্মিলা অনড় দেখে মণিপুরের সাধারণ মানুষ থেকে জঙ্গি নেতা, সবাই বলতে শুরু করেছেন— এই ডেসমন্ডই যত নষ্টের গোড়া। শর্মিলাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকেই বলছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’। মণিপুরের দুই কট্টর জঙ্গি সংগঠন কেওয়াইকেএল ও কেসিপি সরাসরি শর্মিলাকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে— ডেসমন্ডের প্রেম আসলে ভারত সরকারের পাতা ফাঁদ। আন্দোলনের আদর্শ ছেড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক করেননি তিনি। সিদ্ধান্ত বদল করতে হবে। ভোটে দাঁড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না।

তবে এই পরিস্থিতিতে বছর ৪৪-এর শর্মিলার পাশে দাঁড়িয়েছেন মালোম বাসস্ট্যান্ডে নিরাপত্তাবাহিনীর হামলায় নিহতদের পরিজনদের একাংশ। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই ২০০০ সালের ৪ নভেম্বর থেকে অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা। চানুর অনশনের ১৫ বছর পর মণিপুর হাইকোর্ট ওই ঘটনাকে ‘ভুয়ো সংঘর্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিহতদের পরিজনদের ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

হাসপাতালে বন্দি চানুর হয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা, সেই দাদা সিংহজিৎ বা মানবাধিকার কর্মী বাবলু লোইতংবামরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে আগ্রহী নন। সিংহজিৎ এ দিনও বলেন, শর্মিলার সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তিগত। তবে তাঁদের মা যে শর্মিলার এই সিদ্ধান্তে আদপেই খুশি নন, তা জানিয়েছেন তিনি। আর যাঁকে বিয়ে করতে চেয়ে এত কাণ্ড, সেই ডেসমন্ড কি আসবেন মণিপুরে? ই-মেল করে আপাতত কোনও জবাব মেলেনি তাঁর কাছ থেকে।

ইরানের মানবাধিকার কর্মী, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক শিরিন এবাদি থেকে শুরু করে মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও স্কুলপড়ুয়া, এত দিনের লড়াইয়ে শর্মিলা পাশে পেয়েছিলেন অনেককেই। কিন্তু এখন নিজের মতো করে বাঁচার লড়াইটা হয়তো তাঁকে একাই লড়তে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন