বাজেটে নজর শিল্পমহলের

প্রকল্প অজস্র, বিনিয়োগ তবু অধরাই

গত আড়াই বছরে লগ্নি টানতে কাঠখড় কম পোড়াননি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কখনও দেশে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ টানতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, কখনও দক্ষ কর্মীর জোগান বাড়াতে ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, কখনও আবার দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত শিল্প-করিডর।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০০
Share:

গত আড়াই বছরে লগ্নি টানতে কাঠখড় কম পোড়াননি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কখনও দেশে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ টানতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, কখনও দক্ষ কর্মীর জোগান বাড়াতে ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, কখনও আবার দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত শিল্প-করিডর। সঙ্গে পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালুর স্বপ্ন দেখানো তো আছেই। কিন্তু তবু শিল্পে বিনিয়োগের ফুল এখনও ফোটেনি। বিদেশি বিনিয়োগ সে ভাবে আসেনি। হাত গুটিয়ে রয়েছেন দেশি শিল্পপতিরাও।

Advertisement

এ বারের বাজেট তাই লগ্নি টানার ক্ষেত্রে অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠেছে মোদী-জেটলির সামনে। এখনও পর্যন্ত বারবার শিল্পমহলকে লগ্নির আহ্বান জানিয়ে তেমন লাভ হয়নি। বিস্তর ঢাকঢোল পেটানো সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে। তাই ১ ফেব্রুয়ারি বাজেটে কোন তাস অস্তিন থেকে বার করলে শেষমেশ বিনিয়োগ আসবে, সেই উত্তরই এখন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা।

শিল্পপতিদের মতেও, এই ‘শেষ’ সুযোগ। শিল্পের জন্য জরুরি সংস্কার সেরে ফেলতে হবে এ বারই। কারণ আগামী বছর বাজেট হবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে। ফলে সেখানে সংস্কারের কড়া দাওয়াইয়ের বদলে জনমোহিনী খয়রাতিই বেশি থাকার সম্ভাবনা।

Advertisement

মোদী জমানায় লগ্নির ‘অচ্ছে দিন’ যে আসেনি, তা বোঝা যাচ্ছে সরকারি পরিসংখ্যানেও। নতুন বিনিয়োগ কত হচ্ছে, তা বোঝা যায় বাজেটে ‘গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন’-এর হার দেখে। ২০১৪-’১৫ সালে তা ছিল জিডিপির ৩২.৩%। ২০১৫-’১৬ সালে ৩১.২%। আর পরিসংখ্যান মন্ত্রকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষে তা নেমে আসতে পারে ২৯.২ শতাংশে। তা-ও আবার নোট বাতিলের প্রভাব না ধরে। যার জেরে তা আরও কমার আশঙ্কা। ২০০৮ সালে বিশ্বজোড়া মন্দার পরেও লগ্নির এত খারাপ দশা আর হয়নি।

অর্থনীতিবিদ সুরজিৎ ভাল্লা বলছেন, ‘‘শিল্পের নয়া দিশা দরকার। সে দিক থেকে এ বারের বাজেট ১৯৯১ সালের মনমোহন সিংহের বাজেটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’’

শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে চেষ্টা কম হয়নি। মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পে প্রতিটি শিল্পের জন্য পৃথক নীতি হয়েছে। স্কিল ইন্ডিয়ার মাধ্যমে দক্ষ কর্মী তৈরির চেষ্টা হয়েছে। স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে নতুন শিল্পোদ্যোগীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। শ্রম আইন সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। আর কী করলে শিল্পমহলের আস্থা মিলবে, কে জানে!’’

লগ্নি কই

বছর লগ্নি-জিডিপি অনুপাত

২০১৪-’১৫ ৩২.৩%

২০১৫-’১৬ ৩১.২%

২০১৬-’১৭ ২৯.২%*

* পূর্বাভাস। নোট বাতিলের ধাক্কা না ধরে

তাহলে শিল্পমহল লগ্নিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না কেন?

বণিকসভার কর্তারা বলছেন, এর অন্যতম কারণ জমি অধিগ্রহণের অসুবিধা। ক্ষমতায় এসেই শিল্পের জন্য সহজে জমির বন্দোবস্ত করতে অধিগ্রহণ আইনে বদল করে অর্ডিন্যান্স এনেছিলেন মোদী। পরে রাজনৈতিক বিরোধিতায় হাল ছাড়তে হয়। তার উপর বহু শিল্পসংস্থার খাতাতেই শোধ করতে না পারা ঋণের অঙ্ক লাল চোখ দেখাচ্ছে। বাজারে চাহিদা এমনিতেই কম ছিল। এখন নোট বাতিলের জেরে তা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। এ দিন কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম আবার বলেছেন, কর নিয়ে বিভ্রান্তি আর হয়রানির ভয়ে টাকা ঢালার দিকে এগোতে চাইছেন না শিল্পপতিরা। ফলে এক পা এগোতে গিয়েও তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

শিল্পমহলকে লগ্নিতে উৎসাহ দিতে বাজেটে কী করতে পারেন জেটলি? অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, কর্পোরেট করের হার কমতে পারে। কিন্তু সে আর কতখানি! খুব বেশি হলে ৩০% থেকে কমে ২৮% হতে পারে। বোঝা কমতে পারে ন্যূনতম বিকল্প করেরও (ম্যাট)। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে খুব দ্রুত জিএসটি চালুর। ঘোষণা হতে পারে দিল্লি-মুম্বই, অমৃতসর-কলকাতার মতো যে পাঁচটি শিল্প-করিডর তৈরির কথা ঘোষণা হয়েছে, সেগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার বিষয়ে। যাতে লগ্নিতে সুবিধা হয়। যে সব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, সেখানে কিছু করছাড় দেওয়া হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা নির্ভর নতুন সংস্থার জন্য আরও বেশি সময় ধরে করছাড়ের সুবিধার কথাও ঘোষণা হতে পারে।

কিন্তু তাতে কি চিঁড়ে ভিজবে?

বাজেটের আগে শিল্পমহল ও বণিকসভার সঙ্গে আলোচনায় জেটলি বলেছেন, লগ্নি টানতে সরকার সাধ্যমতো বিনিয়োগ করেছে। আর্থিক বৃদ্ধির ইঞ্জিনে জ্বালানি ভরতে এ বার শিল্পমহলও এগিয়ে আসুক। কিন্তু শিল্পমহলের অভিযোগ, জেটলি প্রতি বছর পরিকাঠামোয় সরকারি লগ্নির বরাদ্দ বাড়ালেও বাস্তবে ব্যয় হয়েছে তার থেকে অনেক কম।

সেই সঙ্গে শিল্পপতিদের দাবি, বাজেটে কর্পোরেট কর যথেষ্ট পরিমাণে কমানো হোক। পদক্ষেপ করা হোক লগ্নি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য। সহজ হোক সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের নিয়ম। নোট বাতিলে ধাক্কা খাওয়া বাজারে চাহিদা ফের চাঙ্গা করারও বন্দোবস্ত করুক মোদী সরকার। মূল্যায়ন সংস্থা ক্রিসিলের অর্থনীতিবিদ ডি কে জোশীর কথায়, ‘‘এতদিন ছিল শুধু লগ্নি টানার চেষ্টা। এ বার তার জন্য কেনাকাটা বাড়ানোর রাস্তাও খুঁজতে হবে জেটলিকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন