মৃত্যু-খনি/১

মেঘালয়ে খনি বিপর্যয়: দেহ মিললে ক্ষতিপূরণ, তাই অপেক্ষায় শ্রমিকের পরিবার

আই নদীর শুকনো বুক জুড়ে চলছে ১২ দিনের সরকারি দিজিং (নদীর পাড়) উৎসব। অসমের চিরাং জেলা গমগম করছে হিমেশ রেশমিয়ার গানে, “আই ডোন্ট নো বেবি, হ্যায় কিসকা কসুর।” অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল আর বড়োল্যান্ড প্রধান হাগ্রামা মহিলারি দাবি করেছেন, অপেক্ষা করুন। দিন বদল হবেই।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

চিরাং শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৫
Share:

অসহায়: নিখোঁজ খনি-শ্রমিক আমির হুসেনের পরিবার। নিজস্ব চিত্র

আই নদীর শুকনো বুক জুড়ে চলছে ১২ দিনের সরকারি দিজিং (নদীর পাড়) উৎসব। অসমের চিরাং জেলা গমগম করছে হিমেশ রেশমিয়ার গানে, “আই ডোন্ট নো বেবি, হ্যায় কিসকা কসুর।” অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল আর বড়োল্যান্ড প্রধান হাগ্রামা মহিলারি দাবি করেছেন, অপেক্ষা করুন। দিন বদল হবেই।

Advertisement

অপেক্ষায় সালেবুর রহমান, আব্দুল মিঞা, অভিযানা খাতুনেরাও। অপেক্ষা তিনটে দেহের। দেহ মিললেই তো হাতে আসবে ক্ষতিপূরণের লক্ষ টাকা। অসমের ছ’টি ছোট্ট ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ তত দিন আটকে থাকবে পড়শি মেঘালয়ের ৩৫০ ফুট গহ্বরে, ৭০ ফুট জলের তলায়। যেখানে শেষ বারের মতো নেমেছিল তাদের আব্বারা।

মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া হিল জেলায় কসানে কয়লাখনিতে গত ১৩ ডিসেম্বর জল ঢুকে যে ১৫ জন নিখোঁজ, তাঁদের মধ্যে তিন জন অসমের চিরাঙের বাসিন্দা। সেই আমির হুসেন, মনিরুল ইসলাম ও সাহের ইসলামের বেঁচে ফেরার আশা অনেক আগেই ছেড়েছে পরিবার। মেঘালয় সরকার ১ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেও বলা হয়েছে, মৃতদেহ উদ্ধার না হলে মিলবে না টাকা। তাই অপেক্ষা।

Advertisement

২০১৪ সালে জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল মেঘালয়ে পরিবেশ ও প্রাণের পক্ষে বিপজ্জনক কয়লা খনন বন্ধ করে দেওয়ার পরেও রমরমিয়ে চলছে কয়লা তোলা। নিরাপত্তা বলতে মাথায় নিম্নমানের প্লাস্টিক হেলমেট। লঝ‌্ঝড়ে পুলি। নীচে নামার পুরনো লিফ‌্ট। ইঁদুরের মতোই পাহাড়ে গর্ত করতে করতে নামতে হয় মজুরদের। তার পর মাটির কয়েকশো ফুট নীচে, উবু হয়ে বসে পাহাড়ের গা কাটতে কাটতে কয়লা তুলে দিতে হয় ঝুড়িতে। এগুলোই ‘র‌্যাট হোল মাইন’।

কিন্তু যেখানে অহরহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়, আরও ভয় যখন-তখন মরে যাওয়ার, কেন এই খনিতে নামা? কেন অসম ছেড়ে যাওয়া মেঘালয়ে?

২০ বছর ধরে মেঘালয়ের খনিতে কাজ করেছেন মনিরুলের বাবা সালিবুর। সেই টাকায় তিন ছেলেকে বড় করেছেন। বড় ছেলে মানিক আলিও ৮ বছর ধরে খনিকর্মী। ছোট ছেলে মনিরুলকেও সেই কাজে পাঠিয়েছিলেন সালিবুর। তিনি জানান, চিরাঙে পড়ে থাকলে পেট চলবে না। রাজ্যে কোথাও ২০০ টাকার বেশি দিনমজুরি মেলে না। সেখানে মেঘালয়ে গিয়ে বেআইনি খনিতে কাজ করলে মজুরি দিনে অন্তত ৮০০ টাকা। খনন নিষিদ্ধ হওয়ার পরে দর আরও বেড়েছে। দক্ষ কর্মীরা দিনে দেড়-দু’হাজার টাকা পান। বাবার কথায়, ‘‘মৃত্যু তো বলেকয়ে আসে না। খনিতে কাজ না করলে টাকা আসবে কোথা থেকে? লেখাপড়া করা ভদ্রলোকেরাও এত টাকা পায় না!’’

এই টাকাই টানছে অন্ধকার গর্তের দিকে। আর এক বছর মাদ্রাসায় পড়া চালালেই মৌলবি হতে পারতেন চিরাঙের ভাঙনামারির সাহের ইসলাম। কিন্তু পাঁচ বছর পড়ার পর মাদ্রাসা ছেড়ে শুরু করেন বাঁশের ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসার অংশীদার চার লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে পালায়। ধার শোধ করার জন্য জয়ন্তিয়া পাহাড়ে যান সাহের। সেখানে দিনে মজুরি বেড়ে দেড় হাজার হয়েছিল। বাবা আবদুল মিঞা জানান, ৯ বছরের ছেলে এবং ৫ ও ৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে পুত্রবধূ সাজেদা দিশেহারা।

পরিবারের একটাই আশা, দেহ উঠলে অন্তত ক্ষতিপূরণের টাকা মিলবে। সাহেরের বাবা আবদুল বলেন, ‘‘সাজিদার বাবা-মা মারা গিয়েছেন। এখন বরও মারা গেল। সে নিজেই অসহায়। বাপ মরা মর্জিনা, মসফিনা, সাজিদুলদের কে দেখবে? মেঘালয় ও অসম সরকার সাহায্য না করলে না-খেয়ে মরব।’’
নিখোঁজ আমিরের স্ত্রী অভিযানা খাতুন আর তিন ছেলেমেয়ের ভার আপাতত নিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দারা। দু’বেলা খেতে পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু অভিযানার কথায়, ‘‘এ ভাবে কত দিন চলবে? সরকার কিছু না দিলে আত্মহত্যা করতে হবে।’’

আরও পড়ুন: দেশ বদলে দেব ভাবিনি, বিস্ময় মোদীর মন্তব্যে

তাঁরা যদি জানতেন, ‘হীরক রাজার দেশে’র খনি শ্রমিক বলেছিল, ‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম’!

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন