স্বামী ব্যক্তিগত আক্রমণ যতই চরমে তুলুন, অরুণের বিকল্প দেখছেন না মোদী

আস্থা অটুট অরুণেই। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ব্যক্তিগত আক্রমণ যতই চরমে তুলুন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অরুণ জেটলিকে সরাচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬ ০৪:০০
Share:

আস্থা অটুট অরুণেই।

Advertisement

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ব্যক্তিগত আক্রমণ যতই চরমে তুলুন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অরুণ জেটলিকে সরাচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী।

গত কাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠকের পর জুলাইয়ের গোড়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সম্ভাবনা বেড়েছে। উপরন্তু আজ মন্ত্রক ধরে ধরে কাজের অগ্রগতির বিশ্লেষণ করেছেন মোদী। বাজেটে প্রকল্প ঘোষণার পরের দিন থেকেই যাতে কাজ শুরু হয় এবং তার সুফল তৃণমূল স্তরে পৌঁছয়, সেই নির্দেশ দিয়েছেন। ক্যাবিনেট সচিব ও প্রধান সচিবের সহায়তার মন্ত্রীদের রিপোর্ট কার্ড বানানোর প্রস্তুতিও শুরু করেছেন।

Advertisement

এই সম্ভাব্য রদবদলের আগেই অর্থ মন্ত্রক থেকে জেটলিকে সরাতে কোমর বেঁধেছেন স্বামী। ‘অনির্বাচিত কুকুর’— এমন শব্দবন্ধও লিখে ফেলেছেন সোশ্যাল সাইটে (অনেকের মতে, ইঙ্গিতটা লোকসভায় জেটলির হারের দিকে)। স্বামীর নেপথ্যে সঙ্ঘের একাংশেরও যে মদত রয়েছে, মোদী তা জানেন। তা সত্ত্বেও জেটলিকে সরানোর কথা ভাবছেন না তিনি।

এই আস্থার প্রধান কারণ, জেটলি অত্যন্ত সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মন্ত্রক চালাচ্ছেন বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। অতীতে অর্থ মন্ত্রকে বিভিন্ন কায়েমি গোষ্ঠীর সক্রিয়তার অভিযোগ উঠত। বিষয়টা টুজি হোক বা ভোডাফোন চুক্তি। জেটলির ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, ইউপিএ জমানায় প্রতি বুধবার প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন এক শিল্পপতি। এখন অর্থমন্ত্রীর ‘ভিজিটর্স রুম’ একেবারেই খালি থাকে। ‘লবিস্টের’ দলও উধাও।

জেটলি নিজে অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি কাউকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্যও কোনও ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেননি। অর্থ মন্ত্রকের অধীনে থাকা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র কাজেও তিনি কখনওই নাক গলান না। বিজেপি শীর্ষ নেতাদের দাবি, সেই ইন্দিরা গাঁধীর আমল থেকেই দেশের অর্থমন্ত্রীর একটি পরোক্ষ দায়িত্ব ছিল তহবিল সংগ্রহ। জেটলি এসে এই সমস্ত রেওয়াজেই ইতি টেনেছেন। কাজেই তাঁকে সরাতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ যে থাকবে, সেটা খুব স্বাভাবিক।

কিন্তু জেটলিকে সরানোর চাবিকাঠি মাত্র দু’জনের হাতে। এক, প্রধানমন্ত্রী। দুই, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। মোদী মনে করেন, জেটলির কোনও বিকল্প নেই। তা স্বামীর আক্রমণের ঝাঁঝ যতই বাড়ুক না কেন। আর জেটলির বিরুদ্ধে ভাগবত কিংবা সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বের উষ্মার কারণ দেখছেন না নেতাদের অনেকেই। কারণ, অর্থনীতির হাল ইউপিএ আমলের থেকে ভাল হয়েছে, বৃদ্ধির হার বেড়েছে। সরকারের অর্থনীতির মডেলে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের মতো সঙ্ঘের শাখা সংগঠনেরও উদ্বেগের কিছু নেই বলে তাঁদের মত।

অর্থমন্ত্রীর পদটি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে প্রধানমন্ত্রীরা ভেবেচিন্তে এই পদে নিয়োগ করেছেন। জয়রাম রমেশ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় নিশ্চিত ছিলেন, তিনি অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন। এমনকী প্রণববাবু নাকি তাঁকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, জয়রাম তাঁর সঙ্গে নর্থ ব্লকে থাকতে চান, নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাউথ ব্লকে? তার পর দেখা যায়, ইন্দিরার মন্ত্রিসভার অঘোষিত ‘নম্বর টু’ প্রণববাবুকে অর্থমন্ত্রীর পদ দেননি রাও। তিনি চেয়েছিলেন আই জি পটেলকে। পটেল রাজি হননি। তার পর মনমোহন সিংহকে অনুরোধ করায় তিনি রাজি হয়ে যান। হর্ষদ মেটার কেলেঙ্কারির পর মনমোহনকে সরানোর জন্য বিরাট চাপ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মনমোহনকে সরালে প্রণববাবু কিংবা চিদম্বরমকে অর্থমন্ত্রী করতে হতো। তাই তখনও মনমোহনকে সরাননি রাও। এর পরেও বিভিন্ন জমানায় অর্থ মন্ত্রকে মাঝপথে বদল দেখা গিয়েছে। মনমোহনের আমলে চিদম্বরম ও প্রণববাবু অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। এমনকী বাজপেয়ী জমানাও দু’জন অর্থমন্ত্রী দেখেছে— যশোবন্ত সিংহ এবং যশবন্ত সিন্হা। এখন মোদীর আমলে স্বামী চাইছেন অর্থমন্ত্রীর কুর্সি।

অথচ মাত্র ক’দিন আগে টিভিতে স্বামীর সমালোচনা করেছেন মোদী। তার পরেও স্বামী বলেছেন, তিনি প্রচার চান না, প্রচার তাঁর পিছনে ঘোরে। তাঁর বাড়ির সামনে ত্রিশটি চ্যানেল ও মোবাইলে সংবাদমাধ্যমের দু’শোটি মিস্ড কল রয়েছে। আজও টুইটারে স্বামী লিখেছেন, ‘সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও অন্যদের থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম।’ সুষমা দলে জেটলি-বিরোধী শিবিরের নেত্রী বলেই পরিচিত।

অনেকেরই প্রশ্ন, এখনও স্বামী এত সাহস পান কী করে? একটা কারণ অবশ্যই সঙ্ঘের একাংশের সমর্থন। সঙ্ঘের প্রভাবেই তিনি রাজ্যসভায় এসেছিলেন। ‌কিন্তু স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা দুষ্কর, ইতিহাসই তার সাক্ষী। এই ‘জেটলি হঠাও’ অভিযানও যতটা না স্বামীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সঙ্ঘের ততটা নয়।

সব চেয়ে বড় কথা, অর্থ মন্ত্রকের আসল রাশ এখনও মোদীরই হাতে। আর্থিক উপদেষ্টাদের পরামর্শে বাজেটটা তিনিই তৈরি করেন। ফলে সঙ্ঘের পক্ষে জেটলিকে আলাদা করে নিশানা করা শক্ত। এর পরেও যদি সঙ্ঘ থেকে জেটলিকে সরানোর প্রবলতম চাপ আসে, সে ক্ষেত্রেও অর্থ মন্ত্রক নিজের হাতে রাখার পক্ষপাতী নন মোদী। কারণ তখন যাবতীয় আর্থিক দায় তাঁর উপরেই বর্তাবে। মোদী সেটা চান না।

তবে স্বামীর লাগাতার আক্রমণের মুখে জেটলি এখন কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। চিন সফর থেকে ফিরেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রশ্ন করেছেন, আমার কি অর্থ মন্ত্রক ছেড়ে দেওয়া উচিত? প্রধানমন্ত্রী তখনই আশ্বস্ত করেন, সঠিক সময়েই স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবেন তিনি। সে দিনই টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে স্বামীকে ভর্ৎসনা করেন মোদী। প্রকাশ্যে আস্থা রাখেন জেটলিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন