সংস্কারের আশায় জল, কারাটের কট্টর পথে হাঁটছেন মোদী

ছিল সংস্কারমুখী ভারতের স্লোগান। হয়ে গেল প্রকাশ কারাটের কট্টরবাদ! ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদী যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিলেন, তাতে বহু মানুষ মনে করেছিলেন, দেশের অর্থনীতির অভিমুখ এ বার বদলে দেবেন তিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০৩:২২
Share:

ছিল সংস্কারমুখী ভারতের স্লোগান। হয়ে গেল প্রকাশ কারাটের কট্টরবাদ!

Advertisement

ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদী যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিলেন, তাতে বহু মানুষ মনে করেছিলেন, দেশের অর্থনীতির অভিমুখ এ বার বদলে দেবেন তিনি। জগদীশ ভগবতী, অরবিন্দ পানাগড়িয়ার মতো অর্থনীতিবিদের কথা শুনে শিল্পপতিরা বলেছিলেন, এ বার আমেরিকার রিপাবলিকান দলের ধাঁচে এগিয়ে চলবে বিজেপি।

কিন্তু সরকারে আসার ২২ মাস পরে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই যেন বামপন্থী পথে চলতে শুরু করেছেন মোদী। সংস্কার নয়, সরকারি নিয়ন্ত্রণই যেন তাঁর লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গের সাতটি চা বাগান রুগ্‌ণ হয়ে গিয়েছে বলে কেন্দ্র অধিগ্রহণ করে নিল এক কথায়। ব্যাঙ্ক বা বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের পথে না-হেঁটে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়ল। প্রসার ভারতী থেকে শুরু করে পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে সরকারের বাড়াবাড়ি রকমের খবরদারি নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক হল। বহু দশক পরে ফের সরকারি উদ্যোগে ইস্পাত কারখানা তৈরির ভাবনা দেখা গেল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া, এনএমডিসি এবং আরআইএনএল অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম, ছত্তীসগঢ়ের বস্তার ছাড়াও ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে ইস্পাত কারখানা গড়ার পরিকল্পনা করেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মামে ৩০ লক্ষ টনের ইস্পাত কারখানা বিশ্ববাজারে চাহিদার অভাবে স্থগিত হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সরকারের দিশা। আর এ সবের পরে বাজেটে বহাল রইল ভর্তুকি। মোদী শিল্পপতিদের কাছে কৃষি ভর্তুকির পক্ষে সওয়ালও করে এলেন।

Advertisement

সরকারের যুক্তি কী? জেটলি আজ বলেন, ‘‘বিশাল জনসংখ্যার স্বার্থ বিঘ্নিত করে কোনও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র চলতে পারে না। কাজেই আমার বাজেটকে মার্কসবাদী বাজেট বললে আমি ক্রুদ্ধ হব না। বলব, পরিভাষা ছেড়ে বলুন এ বাজেট গরিব মানুষের বাজেট। যাঁরা এ দেশের মেরুদণ্ড।’’

এ বার বাজেট তৈরির পিছনে প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই বাজেট সামগ্রিক ভাবে তাঁর রাজনৈতিক পথনির্দেশিকা। সরকারে যখন আসেন, তখন আর্থিক সংস্কারে কঠোর দাওয়াইয়ের কথা ভেবেছিলেন মোদী। কিন্তু বাস্তবে তা করা সম্ভব হয়নি। বাজপেয়ী জমানায় বিলগ্নিকরণের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রক ছিল। এ সরকারে সেটিও নেই। যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ হয়েছে বটে, কিন্তু তার ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। উন্নয়নের অ্যাজেন্ডাকে সরকারি নাগপাশ মুক্ত করার কাজে এগোতে পারেননি মোদী।

বিবেক দেবরায়ের মতো অর্থনীতিবিদ অবশ্য মনে করেন, যোজনা বরাদ্দ তুলে দেওয়াই যথেষ্ট বৈপ্লবিক কাজ। রেলের ক্ষেত্রেও প্রচুর সংস্কার হচ্ছে। সেগুলির সুফল ক্রমশ পাওয়া যাবে। কিন্তু সংস্কার মানে আমজনতার কথা ভুলে যাওয়া নয়। এত বড় দেশে বহুত্ববাদ মাথায় রেখে মধ্যপন্থা নেওয়া স্বাভাবিক।

অর্থনীতিবিদ বিমল জালান আবার বলেন, ‘‘সমস্যা নীতি নিয়ে নয়। আমাদের দেশে নীতির অভাব নেই। কিন্তু নীতি বাস্তবায়নের জন্য সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই। আমাদের প্রয়োজন প্রশাসনিক সংস্কার।’’ আমলাতন্ত্রে এখনও সেই বদল হয়নি বলেই অভিযোগ। আর জয়রাম রমেশের মতো কংগ্রেস নেতাদের দাবি, উদার আর্থিক সংস্কার নয়, জাতীয়তাবাদের নামে একনায়কতন্ত্রের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।

মোদী সফল মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতাও সুবিদিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর লক্ষ্য কী? এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, মোদীর রোল মডেল এখন ইন্দিরা গাঁধী। তিনি গরিবি হটাও ও ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের স্লোগান দিয়ে সোভিয়েত ধাঁচে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পথে গিয়েছিলেন। সেই পথ ছেড়ে ১৯৯১-এ নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ খোলা বাজারের হাওয়া এনেছিলেন। কিন্তু এ বার কি উল্টো রথ?

জেটলি অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন আর্থিক সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সেটা কোনও ঢক্কানিনাদের মধ্যে নয়। সংস্কার আর সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, যে একটি শেষ হলে তবে আর একটি শুরু হবে। প্রণব মুখোপাধ্যায় বরাবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরামর্শ দিতেন, বিলগ্নিকরণ নিঃশব্দে করাটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ, এ দেশের সংস্কৃতি এখনও দরিদ্রকল্যাণের স্লোগানে নিমজ্জিত।

মোদী-জেটলিও কি তবে ইন্দিরার সেই কৌশলী পোশাক গায়ে দিয়েছেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন