রাম-সীতার জন্মসূত্রে ভারত-নেপাল সেতুবন্ধন

রামের জন্মভূমি অযোধ্যা এত দিন হাতিয়ার ছিল রাজনীতির। এ বার সীতার জন্মভূমি মিথিলাকে কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে বেছে নিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার! মদেশীয়দের অধিকার ও অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে নেপালের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে কিছু ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

জনকপুর (নেপাল) শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:০৭
Share:

নেপালে জনকপুরে জানকী মন্দিরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। — নিজস্ব চিত্র

রামের জন্মভূমি অযোধ্যা এত দিন হাতিয়ার ছিল রাজনীতির। এ বার সীতার জন্মভূমি মিথিলাকে কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে বেছে নিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার!

Advertisement

মদেশীয়দের অধিকার ও অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে নেপালের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে কিছু ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। হিন্দুত্ব ও কূটনীতির মিশেলে সেই দূরত্ব কমাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। কৌশল ত্রিমুখী:

রামায়ণের অযোধ্যা উত্তরপ্রদেশে। আর মিথিলা এখন নেপালের তরাই এলাকার জনকপুর। মিথিলার রাজা জনকের নামে সীতার জন্মভূমির নাম হয়েছে জনকপুর। সরকারের প্রথম লক্ষ্য, রামের অযোধ্যা ও সীতার জনকপুরকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা।

Advertisement

দ্বিতীয় চেষ্টা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেপালের গোর্খাদের সুদীর্ঘ ও দৃঢ় সম্পর্কের কথা তুলে ধরে, হালে তৈরি হওয়া দূরত্ব বাড়তে না দেওয়া।

যাঁদের আন্দোলনের জেরে ভারত সম্পর্কে কাঠমান্ডুতে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেই মদেশীয়দের সঙ্গে প্রচণ্ড সরকারের দূরত্ব কমাতে উৎসাহ জোগানো।

চেনা মাঠ নেপালে এসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এই তিনটি কাজকেই বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র নেপালেই হিন্দুরা সংখ্যাগুরু। সেই নেপালের মন জিততে কূটনীতির সঙ্গে হিন্দুত্বকে ব্যবহার করার সুযোগ বরাবরই ছিল। বর্তমান বিজেপি সরকারের সেটা খানিকটা প্রত্যাশিতও বটে। অযোধ্যা ও জনকপুরকে সম্প্রতি যমজ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই থামছে না নয়াদিল্লি। রামায়ণের সঙ্গে জড়িত ভারতের তীর্থস্থানগুলিকে নিয়ে যে পর্যটন সার্কিট রয়েছে, সেই ‘রামায়ণ পরিক্রমা পথ’-এর সঙ্গে নেপালের জনকপুরকেও জুড়ে নেওয়া হবে এ বার। এখানকার জানকী মন্দির সীতার জন্মস্থানের উপরেই তৈরি বলে কথিত। রয়েছে রাম-সীতার বিবাহমণ্ডপও। এই পরিক্রমা পথে জনকপুরে দু’টি ধর্মশালা তৈরি করবে ভারত। যাতে আরও বেশি সংখ্যায় তীর্থযাত্রী জনকপুরে আসতে পারেন।

নেপালের তরাই এলাকায় এই জনকপুর মদেশীয় অধ্যুষিত। নেপালের সংবিধানে সমানাধিকারের দাবিতে এই মদেশীয়রাই গত বছর অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলেছিলেন। কাঠমান্ডুতে তেল ও জরুরি পণ্যের জোগানে টান পড়ে তাতে। একে ভারতেরই প্ররোচনা ও অঘোষিত অবরোধ হিসেবে দেখেছে কাঠমান্ডু। অভিযোগ উঠেছে, ভারত আসলে নেপালের উপরে চাপ তৈরি করে এ দেশের সংবিধান তৈরিতে নাক গলাতে চাইছে। যার সূত্রে নেপালের অধিকাংশ এলাকায় এখনও ভারত সম্পর্কে একটা বিদ্বেষের মনোভাব রয়েছে। এই বিদ্বেষ দূর করে ফের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ফেরাতেই নেপাল সফরে এসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

নয়াদিল্লি মদেশীয়দের উপর নিজের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। একই সঙ্গে কাঠমান্ডুর প্রচণ্ড-সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। রাষ্ট্রপতির সফরসূচিতে তাই সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা ছিল জনকপুর। গত কাল জনকপুরে জানকী মন্দিরে পৌঁছে, রাম-সীতার মূর্তির সামনে মেঝেতে আসন করে বসে পুজো দেন প্রণব। তার পর জনকপুরের নাগরিক সংবর্ধনায় বলেন, “রাজা দশরথ ও রাজা জনক যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, অযোধ্যা ও জনকপুরের মানুষ তারই উত্তরাধিকারী। নেপালের সঙ্গে এই অভিনব সম্পর্ককে ভারতের মানুষ যথেষ্ট মূল্য দেয়।” এই সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যেই মদেশীয় নেতাদের রাষ্ট্রপতি বুঝিয়েছেন, তাঁরা যেন সংবিধান তৈরিতে প্রচণ্ড-সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। কাঠমান্ডুতে প্রণবের সঙ্গে দেখা করে মদেশীয় নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, নেপাল সরকার বরাবর তাঁদের ঠকিয়েছে। এ বার সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রেও ঠকাবে। সংবিধানে তাঁদের সমানাধিকার বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

দিল্লি ফেরার আগে প্রণব কাল বলেন, “সমস্যাটা আমি জানি। মদেশীয় নেতারা আগেও দিল্লিতে ঘরোয়া ভাবে আমার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওঁদের সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। নেপাল সরকারকেও সংবিধান তৈরির সময় সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে চলতে হবে। ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। কারণ, সংবিধান চিরস্থায়ী নথি। আমি আশাবাদী, বাকি সমস্যা মিটে যাবে”।

অর্থনৈতিক অবরোধ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলেও তা শেষ পর্যন্ত থাকবে না বলেই প্রণবের বিশ্বাস। তিনি বলেন, “ভারত-নেপাল সম্পর্ক এক পরিবারের মতো। ভুল বোঝাবুঝি হলেও তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া যায়।” সেই কাজে তিনি যে খানিকটা এগিয়েছেন, তা বুঝিয়ে দিতে প্রণব জানান, তাঁর এই ‘মিশন অব ফ্রেন্ডশিপ’ সাফল্যের সঙ্গেই শেষ হচ্ছে। দু’দেশের সীমান্ত খোলা হলেও তার অপপ্রয়োগ হবে না। দু’দেশের শত্রু রাষ্ট্রগুলি এর সুবিধা নিতে চায়, তাদেরও আটকাতে নেপাল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক কতখানি গভীর, তা বোঝাতে দিল্লি ফেরার পথে পোখরায় ভারতীয় সেনা থেকে অবসর নেওয়া নেপালের গোর্খা জওয়ানদের সভায় যোগ দেন রাষ্ট্রপতি। মনে করিয়ে দেন, ভারতে এখন ৩২ হাজার গোর্খা জওয়ান কাজ করছেন। প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার অবসরপ্রাপ্ত গোর্খা জওয়ান পেনশন পাচ্ছেন। যার পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি নেপালি টাকা। গোর্খা জওয়ানরা সপ্তম বেতন কমিশন এবং এক পদ এক পেনশন নীতির সুবিধাও পাবেন। স্পষ্টতই, রাম-সীতার জন্মস্থানের মধ্যে মেলবন্ধনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে গোর্খা জওয়ানদেরও ভারত-নেপাল মৈত্রীর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে নয়াদিল্লি।

নেপালকে কাছে টানতে সেতুবন্ধন এ বার কূটনীতি এবং হিন্দুত্বেরও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন