আগরার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই।
নোট বাতিলের ঘটনাকে সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে বৃহত্তর বিরোধী জোট গড়তে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোড়া থেকেই অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি-কে সঙ্গে পেয়েছেন তিনি। ক্রমশ দূরত্ব কমছে কংগ্রেসের সঙ্গেও। এমন একটা সময়ে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা বিরোধী ঐক্য ভাঙতে চিট ফান্ডের প্রসঙ্গ তুলে পরোক্ষে তৃণমূল নেত্রীকেই নিশানা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
আজ উত্তরপ্রদেশের আগরায় এক জনসভায় নাম না করে মমতাকে বিঁধে মোদী বলেন, ‘‘আমি জানি, কারা আমার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন! চিট ফান্ড ব্যবসায় কারা টাকা ঢেলেছিলেন, তা কি দেশের মানুষ জানেন না? কোটি কোটি গরিব মানুষ চিট ফান্ডে টাকা রেখেছিলেন। কিন্তু নেতাদের দাক্ষিণ্যে ওই কোটি কোটি টাকা গায়েব হয়ে গিয়েছে! সেই ক্ষতি সহ্য করতে না পেরে বহু পরিবারের রোজগেরে মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। আজ ওই লোকেরা (নেতারা) আমায় প্রশ্ন করছেন!’’
এমন আক্রমণ যে আসতে পারে, সে আঁচ অবশ্য আগেই পেয়েছিলেন মমতা। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী রায়ের মতো তৃণমূল নেতাদের ইতিমধ্যেই সিবিআই নোটিস ধরিয়েছে। কিন্তু গোড়া থেকেই মমতা তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বার্তা দিয়েছেন, এ সবে তিনি ভয় পান না। নোট বাতিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাপান থেকে বক্তব্য রাখার পরেই মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমাকে জব্দ করতে জেলে পুরলে, কণ্ঠরোধ করে মেরে ফেললেও আপস করব না।’’ এ দিনও মোদীর মন্তব্যের জবাবে মমতা টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আপনার নীতির বিরোধিতা কেউ করলেই তাঁর সঙ্গে দুর্নীতি জুড়ে দিচ্ছেন! আপনি কি একাই জাদুকর?’’ নোট বাতিলে মানুষের ভোগান্তিকেই পাখির চোখ করে নিজের ফেসবুকে একটি কবিতাও পোস্ট করেছেন মমতা। তবে তিনি বা তাঁর দলের কেউই চিট ফান্ড নিয়ে মোদীর মন্তব্য প্রসঙ্গে মুখ খোলেননি।
২০১৪-য় লোকসভা ভোটের প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে চিট ফান্ড নিয়েই সুর চড়িয়েছিলেন মোদী-সহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা। কিন্তু তার পর থেকে তাঁদের মুখে ওই প্রসঙ্গ বিশেষ শোনা যায়নি। মাস ছয়েক আগে বিধানসভা ভোটের প্রচারেও চিট ফান্ডের তুলনায় নারদ-কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশি সরব হয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা-সহ একাধিক লগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু করলেও গত দু’বছরে তার বিশেষ অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকী ধৃত অনেকে জামিনও পেয়ে গিয়েছেন। এ নিয়ে সিপিএম-কংগ্রেস একাধিক বার মোদী-দিদি আঁতাঁতের অভিযোগ তুলেছে। রাজ্য বিজেপিরও অনেকে দিল্লির নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ। তার মধ্যেই হঠাৎ মোদীর মুখে চিট ফান্ড প্রসঙ্গ কেন?
বিজেপি সূত্রের মতে, ইদানীং মমতা যে ভাবে মোদী-বিরোধী সুর চড়িয়েছেন, মাসখানেক আগেও এত সরব তিনি ছিলেন না। কেজরীবালের সঙ্গে জোট বেঁধে বিরোধী দলগুলির নেতৃত্ব দিতে চাইছিলেন। তখনও বিরোধী ঐক্য ভাঙতে কেজরীবালের থেকে মমতা ‘ঢের ভাল’, এমন কৌশল নিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। উল্টে মমতার সক্রিয়তা বেড়েছে, বিশেষত নোট-বাতিলের পরে। আগামিকালও সংসদ শুরুর আগে সকাল দশটায় বিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে কৌশল রচনা করবে। সেখানে থাকবে তৃণমূলও।
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা অধীর চৌধুরীর মতো রাজ্য নেতাদের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। মোদী আজ সুকৌশলে তাঁদের অক্সিজেন দেওয়ার পাশাপাশি বাকি দলগুলিকে চিট ফান্ড দুর্নীতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযান থামাতে যাঁরা একজোট হচ্ছেন, তাঁদের গায়েই দুর্নীতির কলঙ্ক। সংসদের গত অধিবেশনেও বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের বোঝাপড়া ছিল বলে কটাক্ষ করতেন বিরোধীরা। এ বারে সেই পরিস্থিতি উল্টে গিয়েছে। সে কারণেই প্রায় হারিয়ে যেতে বসা চিট ফান্ডের প্রসঙ্গ ফের টেনে এনে আসরে নেমেছেন মোদী।
মোদীর তির এবং মমতার জবাব প্রসঙ্গে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘নোট বাতিল হওয়ায় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরই সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী তো কোনও দলের নাম করে কিছু বলেননি। উনি এমন আগ বাড়িয়ে নিজের গায়ে মাখায় মনে হচ্ছে— ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি!’’
রাহুলবাবু যা-ই বলুন, রাজ্য বিজেপির একটা বড় অংশ মনে করে, নানা কারণে তৃণমূলকে পাশে টানতে গিয়ে মোদী-অমিত শাহরা পশ্চিমবঙ্গে দলের পায়ে কুড়ুল মেরেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সারদা-তদন্ত ঠিক ভাবে এগোলে তৃণমূলের অনেক বড় নেতা জালে পড়তেন। নারদ নিয়েও এগোনো হয়নি। ওই সব তদন্ত ফের শুরু হলেও এত দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি-তথ্য উধাও হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা বিজেপির অনেক নেতার।
সিপিএম অবশ্য মোদীর কথার মধ্যে গড়াপেটার গন্ধ পাচ্ছে। দলের পলিটব্যুরো সদস্য তথা সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘মোদী আর মমতার মধ্যে ছায়াযুদ্ধ চলছে! মমতা ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ে মোদীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। মোদী পাল্টা হিসেবে চিট ফান্ডের ফাইল খোলার ভয় দেখাচ্ছেন!’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘চিট ফান্ড নিয়ে আজ বড় বড় কথা বলছেন উনি। সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্তটা ওনারা ধামাচাপা না দিলেই তো অনেক কাজের কাজ হতো!’’