সুসময়ে সুষমা-বসুন্ধরা। ছবি: পিটিআই।
বসুন্ধরা-সুষমা বিতর্ককে এড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বোঝাতে চাইছেন, সব কিছু স্বাভাবিকই আছে। সরকার তার কাজ করে চলেছে। কিন্তু বিতর্কের মাঝেই সংসদের বাদল অধিবেশন স্তব্ধ হওয়া ঠেকাতে এখন তলে তলে বিরোধী জোটকে ভাঙ্গতেও তৎপর হচ্ছে সরকার পক্ষ।
ললিত মোদী বিতর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেন ‘মৌন’, তা নিয়ে নিত্যদিন প্রশ্ন তুলে চলেছে কংগ্রেসের মতো বিরোধী দল। এক সময় মনমোহন সিংহের চারপাশে দুর্নীতি হলেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে যে ভাবে বিজেপি-র মতো বিরোধী দল তাঁকে ‘মৌনমোহন’ বলে কটাক্ষ করত, এখন কংগ্রেসও ঠিক একই ভাবে নরেন্দ্র মোদীর ‘মৌনব্রত’ নিয়ে কটাক্ষ করছে। কিন্তু মৌনতা ভেঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রবিবার রেডিওতে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন, পরে ঝাড়খণ্ড ও বারাণসীতেও উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানে সামিল হন। কিন্তু বসুন্ধরা-সুষমা বিতর্ক নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করলেন না। বরং সেই প্রসঙ্গ এড়িয়েই নিজেই তারিফ করলেন তাঁর সরকারের। ‘সরকার কাজ করে চলেছে’ বলে বোঝালেন, বাইরে যতই বিতর্কের ঝড় উঠুক, তাঁর সরকার উন্নয়নের কাজ থেকে কোনও ভাবেই বিচ্যুত হয়নি।
বিরোধীরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকেও পাল্টা কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। কংগ্রেসের নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘যখন গোটা দেশ প্রধানমন্ত্রীর থেকে ললিত-কাণ্ড নিয়ে তাঁর বিবৃতি প্রত্যাশা করছে, তখন প্রধানমন্ত্রী ফের মৌন থেকেই বললেন সরকার ছুটছে। সরকার আসলে বিদেশে ছুটছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের দুর্দশা কাটছে না।’’ কিন্তু বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীকে আদৌ মৌন বলা যাবে না। বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী লাগাতার বক্তব্য পেশ করছেন। সংবাদমাধ্যমে যতই বিতর্ক চলুক, সরকার নিরন্তর মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী এ দিন সেটিই বুঝিয়েছেন।
কিন্তু মুখে এ কথা বললেও সরকারের কাছে উদ্বেগের বিষয় সংসদের অধিবেশনকে কী করে চালানো হবে। কারণ, কংগ্রেস গোটা অধিবেশনকে স্তব্ধ করে রাখতে চাইছে। এ দিন সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিও সংসদের ভিতরে অন্য বিরোধী দলগুলিকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছেন। যদি এই পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা হলে সংসদের উভয় কক্ষ মিলিয়ে যে প্রায় ৬৫টি বিলে সিলমোহর বসাতে চায় কেন্দ্র, সেগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে চিন্তায় সরকার পক্ষ। সংস্কারের বিলগুলিও এতে থমকে যেতে পারে। মোদী মন্ত্রিসভার এক শীর্ষ মন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘আপাত ভাবে প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, সব কিছু স্বাভাবিক আছে। ঠিক যে ভাবে বসুন্ধরাকেও দিল্লিতে এসে স্বাভাবিক দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি নেত্রীরা ইস্তফা না দিলে যে কংগ্রেস সংসদ চলতে দেবে না, তা স্পষ্ট।’’ এই অবস্থায় বিরোধী জোটে ফাটল ধরাতে এখন থেকেই তলে তলে তৎপর হতে শুরু করল বিজেপি। যাতে অন্য দলের থেকে সমর্থন হাসিল করে বাম-কংগ্রেসকে একঘরে করে দেওয়া যায়।
বিজেপি সূত্রের মতে, এই রণকৌশলে সরকারের লক্ষ্য জয়ললিতা, মমতা, মুলায়ম, মায়াবতী, নবীন, শরদ পওয়ারের মতো নেতাদের সমর্থন আদায় করা। অরুণ জেটলি আমেরিকা থেকে ফিরেই এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরেছেন। তিনি বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন। সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু আমেরিকা গিয়েছেন। সামনের মাসের ১০ তারিখে তিনি ফিরে এসেও বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়ায় সামিল হবেন। জয়ললিতার অনুরোধ মেনে তামিলাড়ুতে ‘সান টিভি’র অনুমোদন আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই টেলিভিশন চ্যানেলটি ডিএমকে শিবিরের নেতা দয়ানিধি মারানের। জয়ললিতা সম্প্রতি আদালত থেকে মুক্তি পেলেও কর্নাটক সরকার ফের তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু জয়ললিতার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তাঁকে আইনি সাহায্যও করছে কেন্দ্রীয় সরকার।
তলে তলে সরকারের এই তৎপরতার ফল ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছে বলে বিজেপি-র দাবি। সমাজবাদী পার্টির নেতা রামগোপাল যাদব যেমন সরাসরি সুষমা স্বরাজের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ললিত মোদীকে সাহায্যের প্রশ্নে সমাজবাদী পার্টি অবস্থান নিয়েছে যে, মানবিক কারণে ললিত মোদীকে সাহায্য করা একবারে যথার্থ। এতে কোনও অপরাধ নেই। রাজনীতিতে থাকলে এ ভাবে সহযোগিতা অনেক সময়ই করতে হয়। কংগ্রেস ও অন্য কিছু বিরোধী দল যে ভাবে এটিকে ‘তিল থেকে তাল’ করছে, বরং তার সমালোচনাই করেছে সমাজবাদী পার্টি। শরদ পওয়ারের দলের নেতা মাজিদ মেননও ললিত মোদীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত কোনও ছোট ঘটনাতেও ললিত মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তা হলে তাঁকে কী করে পলাতক বলা যায়?’’ মমতাকে পাশে পাওয়ার জন্য আমেরিকাতে থাকতেই জেটলি তাঁর তারিফ করেছিলেন। সুষমা স্বরাজের বিরুদ্ধে বিতর্ক দানা বাধার পর সৌগত রায় বিরূপ মন্তব্য করলেও পরে সেটি দলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনকে দিয়ে খণ্ডন করানো হয়। মমতা সরাসরি সুষমার পাশে এসে সরাসরি না দাঁড়ালেও নিরপেক্ষ অবস্থানই নিয়েছেন। নবীন পট্টনায়কের দলের নেতা ভরত্রুহরি মেহতাবও বলেছেন, ‘‘আমরা কংগ্রেসের সুরে সুর মেলাতে চাই না। উপযুক্ত সময়েই আমরা আমাদের অবস্থান জানাব।’’
কিন্তু কংগ্রেসের বক্তব্য, সংসদের অধিবেশন শুরু হতে এখনও অনেক দিন বাকি আছে। ফলে বিরোধীরাও এক জোট হবে। অনেক বিরোধী দল এখনও পর্যন্ত নীরব থাকার কৌশল নিয়েছে। তাদের সিংহ ভাগই কিন্তু প্রকাশ্যে এসে বলছে না, বসুন্ধরা রাজে ও সুষমা স্বরাজরা যা অনিয়ম বা দুর্নীতি করেছেন, তাতে তারা পাশে রয়েছে। ফলে সংসদের ভিতরেও যখন হল্লা হবে, তখন বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ানোও সহজ হবে না। আর কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত সংসদ অচল করার কৌশল নিয়েছে। বিশেষ করে রাজ্যসভায়, যেখানে সরকার সংখ্যালঘু। ফলে অন্য বিরোধী দল যদি নীরবও থাকে, তাহলেও সংসদ অচল করার জন্য কংগ্রেস ও আর কয়েকটি দলের সাংসদই যথেষ্ঠ। সংসদে যদি হট্টগোল হয়, তাহলে বিলগুলি পাশ করানোরও প্রশ্ন থাকছে না। আর ভোটাভুটিরও সুযোগ আসছে না। ফলে সরকার যতই অন্য বিরোধীদের কাছে টানার চেষ্টা করুক, যদি হট্টগোলের কারণে ভোটাভুটিরই পরিস্থিতি না আসে, তাহলে সেই বিরোধী দলগুলির সমর্থনেরই বা কী গুরুত্ব রয়েছে?
(শেষ)