নেতাজি ফাইল আগাথা ক্রিস্টির রহস্য কাহিনি নয়, তোপ অমর্ত্যের

কোনও রহস্য যেখানে নেই, সেখানে রহস্য খোঁজার প্রবণতাকে কার্যত তুলোধোনা করলেন অমর্ত্য সেন। এ যাবৎ লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা নেতাজি-সংক্রান্ত সরকারি নথি প্রকাশ নিয়ে ঢক্কানিনাদ আদতে ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি বলে তোপ দাগলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:৫০
Share:

কোনও রহস্য যেখানে নেই, সেখানে রহস্য খোঁজার প্রবণতাকে কার্যত তুলোধোনা করলেন অমর্ত্য সেন। এ যাবৎ লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা নেতাজি-সংক্রান্ত সরকারি নথি প্রকাশ নিয়ে ঢক্কানিনাদ আদতে ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি বলে তোপ দাগলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।

Advertisement

শনিবার নেতাজি-জয়ন্তীর দুপুরে খাস নেতাজি-ভবনে বসেই অমর্ত্য বলেন, ‘‘নেতাজির জীবনের অবদান, তাঁর আদর্শটাই খাঁটি জিনিস। তিনি কী পরিস্থিতিতে মারা গিয়েছিলেন, এর গুরুত্ব সামান্য।’’ এ দিনই দিল্লিতে নেতাজি-সংক্রান্ত ১০০টি ফাইল প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে কলকাতায় রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং মোদীর নেতাজি ফাইল প্রকাশের আবহে নেতাজি-রহস্য নিয়ে আবেগ উসকে দিয়ে মমতা সদ্য নেতাজি-ভবনেই দাবি করেছেন, ‘‘তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি।’’ এ দিনও দার্জিলিংয়ে মমতা কার্যত নেতাজি-তাসই খেলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, কেন্দ্র রাশিয়া থেকে নেতাজি-সংক্রান্ত ফাইল নিয়ে আসুক।

এই সব দাবিতেই এ দিন কার্যত জল ঢেলে দিয়েছেন অমর্ত্য। নেতাজি-সংক্রান্ত ফাইলে তিনি কতটা কৌতূহলী? জবাবে অমর্ত্যের সরস মন্তব্য, ‘‘এ কোনও আগাথা ক্রিস্টির রহস্য-কাহিনির শেষ নয় আদৌ।’’ বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘নতুন ফাইল প্রকাশের বিষয়ে আমি বাড়তি কৌতূহল নিয়ে খবরের কাগজ পড়ব না। যেমন খোঁজ নেব, পরশুদিন বাদে শান্তিনিকেতনে ফেরার সময়ে বৃষ্টি হবে কি না! আমার ওইটুকুই কৌতূহল।’’ অমর্ত্য পরে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘আমাদের আসল জিনিস, নেতাজির জীবন, মতাদর্শ নিয়ে ভাবা উচিত। ভুলভাল কিছু নিয়ে এত উত্তেজনার মানে হয় না।’’

Advertisement

নেতাজির মৃত্যু প্রসঙ্গে অমর্ত্যের মত, ‘‘নেতাজি-মৃত্যু নিয়ে যা প্রামাণ্য তথ্য মিলেছে, তা না-মানার কারণ নেই। আর নেতাজি যে এখনও বেঁচে আছেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’’ নেতাজিকে নিয়ে রাজনীতির অপচেষ্টাকেও এক হাত নিয়েছেন অমর্ত্য। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা ভাবেন, নেতাজি ভবিষ্যতে কোনও হিন্দু সাধুবাবা হয়ে পারেন, তাঁদের নেতাজিকে বুঝতে পুরোপুরি ভুল হয়েছে।’’ ‘গুমনামি বাবা’ বা ‘শৌলমারির সাধু’ যে নেতাজি, এই তত্ত্ব এ দিন উড়িয়ে দিয়েছেন নেতাজির দুই জীবনীকার, প্রবীণ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লেনার্ড গর্ডন ও সুগত বসু। সুগত ঘটনাচক্রে তৃণমূল সাংসদ এবং নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসুর পুত্র। প্রয়াত শিশিরবাবুর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সুগত বলেন, সত্তরের দশকে বাবা লক্ষ্য করেছিলেন, দেশে ভেজাল ও উদ্ভট নেতাজি-মূর্তির কারবার চলছে।’’ নেতাজির মৃত্যু নিয়ে দলনেত্রী মমতার অভিমতকেও উড়িয়ে দিয়ে সুগত বলেন, ‘‘উনি কিন্তু তো নিজেই বলেছেন, এটা ওঁর মনের ভুল হতে পারে। আমি বলছি, এটা ওঁর (মমতা) মনের ভুলই।’’ তবে মোদী সরকার নেতাজিকে কার্যত গুমনামি বাবা বলে জাহির করে অপমান করছে বলেও সুগতের অভিযোগ। তাঁর দাবি, এ দিন মোদীর সঙ্গে দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভস মিউজিয়মে ছিলেন অনুজ ধর বলে এক ব্যক্তি। তিনি গুমনামি বাবা-তত্ত্বের হয়ে সওয়াল করছেন। এ সব অনৈতিহাসিক তথ্যকে সমর্থনের ভিত্তি নেই বলে সুগতের দাবি। তবে বসু পরিবারের মধ্যেই এ নিয়ে ভিন্ন সুর আছে। নেতাজির ভাইপো অমিয়নাথ বসুর পুত্র চন্দ্র বসুরও মত, ‘‘বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ থাকলেও নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ নেই।’’ সুগতের মা প্রাক্তন সাংসদ তথা অধ্যাপক কৃষ্ণা বসুর মত, ‘‘ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বোঝা গিয়েছে। নেতাজি বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গিয়েছেন।’’

তবে তার থেকেও ঢের চড়া সুরে অমর্ত্য এ দিন কেন্দ্রের মোদী-সরকারের নেতাজি-রাজনীতিকে আক্রমণ করেছেন। সদ্য প্রকাশিত ফাইল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘নেতাজির জীবন শেষ করে দেওয়ার পিছনে কংগ্রেস সরকারের কোনও ভূমিকা খুঁজতে চাওয়াটা কিন্তু উদ্ভট চেষ্টা। এবং শুধুমাত্র আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিসন্ধিমূলক রাজনীতির পক্ষে সুবিধাজনক।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নেতাজি এ দেশের স্বাধীনতা, সাম্য ও সুবিচারের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তবে কোনও সরকারই নেতাজির আদর্শ রূপায়ণে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। আর আজকের সরকার তো আরও কম করেছে।’’ আজকের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা কুকথা বলে বিবেচিত হচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন অমর্ত্য। তাঁর আরও খেদ, হয়তো গণতন্ত্র শব্দটাও কিছু দিন বাদে কুকথা বলে ধরা হবে! নেতাজি যে জাতপাত বা ধর্মের নামে বিভাজনের সর্বতো ভাবে বিরোধিতা করেছিলেন তা মনে করিয়ে দেন অমর্ত্য। তার পর বলেন, ‘‘এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়। কিন্তু তাদের নাম করেই ভুল বোঝানো হচ্ছে। নেতাজির নামে এই প্রবণতার বিরোধিতা করুন। আমি নিশ্চিত, ফাইলে যা-ই বেরোক, তা নেতাজির বিষয়ে আমাদের ধারণায় কোনও গভীর পরিবর্তন ঘটাবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন