মসুরীর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে নয়া পদক্ষেপ প্রশাসনের। —ফাইল চিত্র।
বাঙালি তো বটেই, দেশের অন্য প্রান্তের অন্য রাজ্যের মানুষের কাছে মসুরী অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। কিন্তু সেই পর্যটনস্থল ঘিরে ক্রমে আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আসছে। তাই বড়সড় কোনও বিপদের আগে যাতে তা রোখা যায়, তার জন্য এই শৈলশহরে নানা রকম পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে প্রশাসন। বিশেষ করে মসুরীর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে, মসুরীর উপর পর্যটনের ভার কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল পর্যটকদের নাম নথিভুক্তিকরণ এবং সরকারকে তা জানানো।
এই মর্মে শৈলশহরের প্রতিটি হোটেল, হোমস্টে এবং ধর্মশালাকে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, মসুরীতে কত পর্যটক আসছেন, তার তথ্য জানাতে হবে সরকারকে। রাজ্য পর্যটন দফতরের পোর্টালে সেই তথ্য দিতে হবে হোটেল, হোমস্টে, গেস্ট হাউস এবং ধর্মশালাকে। কারণ?
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, কত পর্যটকের ভার বহন করতে পারছে মসুরী, তা নির্ণয় করা প্রশাসনের লক্ষ্য। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে কী ভাবে পর্যটক আনা যেতে পারে, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন দফতরের কর্তা ব্রিজেন্দ্র পাণ্ডে বলেন, ‘‘ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশের পরই হোটেল, হোমস্টে এবং গেস্ট হাউসের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। কী ভাবে পর্যটকদের নাম নথিভুক্ত করে সরকারি পোর্টালে আপলোড করতে হবে, সে বিষয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।’’
যত সময় গিয়েছে, মসুরীতে পর্যটকের চাপ বেড়েছে। এই শৈলশহরে সড়ক এবং রেলপথে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। দিল্লি থেকে সড়কপথে মসুরীর দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। আর সব চেয়ে কাছের রেলস্টেশন দেহরাদূন মাত্র ২১ কিলোমিটার দূরে। তাই পর্যটকের সংখ্যাও বেড়েছে এই শৈলশহরে। তথ্য বলছে, ১৯৫৮ সালে বছরে দেড় লক্ষ পর্যটকের আনাগোনা ছিল এখানে। ১৯৬৬-তে সেটি পৌঁছোয় ৩ লক্ষে। ২০০০ সালে সাড়ে ৮ লক্ষ। ২০১৯ সালে অর্থাৎ কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে ৩০ লক্ষ পর্যটক মসুরী ঘুরতে গিয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যায় পর্যটকের চাপ বাড়তে থাকায় মসুরীর ভৌগোলিক পরিকাঠামোর উপরেও চাপ বাড়তে শুরু করেছে। এখান থেকেই আশঙ্কার মেঘ ঘনাচ্ছে। একে এই শৈলশহরের বাস্তুতন্ত্র ‘বিপজ্জনক’ অবস্থায় রয়েছে, সেই পরিস্থিতি আরও ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠছে মসুরীর ধারণক্ষমতার থেকে অতিরিক্ত পর্যটকের আনাগোনায়। ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, এই শৈলশহরে ৩০৩টি হোটেল, ২০১টি হোমস্টে এবং ছ’টি ধর্মশালা রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি পার্কিং মিলিয়ে ১২৪০টি গাড়ি রাখার জায়গা রয়েছে। এই সংখ্যার মধ্যেই গাড়ি সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মসুরীতে ৩০,১১৮ জনের বাস। কিন্তু ২০২৩ সালে একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ২০৩৭ সালে এই জনসংখ্যা ২৩ শতাংশ এবং ২০৫২ সালে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যেই এই শৈলশহরে জলের অভাব দেখা দিয়েছে। গঢ়ওয়াল হিমালয়ের পাদদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০৫ মিটার উচ্চতায় এই শৈলশহরটি ভূমিকম্পপ্রবণ জ়োন ৪-এর মধ্যে রয়েছে। এখানে অনেক ইমারত তৈরি করা হয়েছে খাড়াই ঢালে। কোনও কোনও ইমারত আবার ১২ মিটার উচ্চতার থেকেও বেশি। ১২ মিটার পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে জোশীমঠ যখন বসে যায়, তখন বহু বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। অনেককে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। সেই সময়েই মসুরীকে নিয়েও একই রকম আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল। সেই সময় তারা জানিয়েছিল, অতিরিক্ত নির্মাণকাজে ধসের প্রবণতা বাড়ছে। যাতায়াতের জন্য প্রস্তাবিত বিভিন্ন সুড়ঙ্গ নির্মাণের বিষয়টিও মসুরীর বিপদকে বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছে প্রশাসন। দেহরাদূন থেকে মসুরীর প্রস্তাবিত রোপওয়ে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এনজিটি। সব মিলিয়ে, পর্যটকের সংখ্যার উপর রাশ না টানলে বিপদ বৃদ্ধি পেতে পারে মসুরীর। তাই ওই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।