বালুচিস্তান নামে একটি প্রদেশ রয়েছে পাকিস্তানে। ভৌগোলিক পরিমাপে সে দেশের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। সেই প্রদেশই দশকের পর দশক ধরে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উত্তাল। বালুচ জনতা ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব কোনও ভাবেই মানতে নারাজ। স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের দাবিতে প্রাণ বাজি রেখে লড়াই সে মরু-প্রদেশের।
পাকিস্তানের ‘সর্বশক্তিমান’ সেনা বেপরোয়া দমন-নিপীড়ন চালিয়ে মরুভূমির বালিতে মিশিয়ে দিতে চাইছে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি। দ্রোহভাবাপন্ন প্রদেশ, তাই জোটে না নাগরিক পরিষেবাগুলোও। রোজ পিষে দেওয়া হয় মানবাধিকার।
ওয়াজিরিস্তান নামে একটি অঞ্চল রয়েছে পাকিস্তানে। ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব অস্বীকৃত হতে শুরু করেছিল সে তালুকেও। এক দশক আগে লড়াই তীব্রতর হয়েছিল।
পাকিস্তানের সরকার ওয়াজিরিস্তানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, ভূখণ্ডটা ধরে রাখাই ইসলামাবাদের প্রধান লক্ষ্য। নাগরিকরা নেহাৎই গৌণ। ২০০৯ সাল থেকে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের স্থানীয় জনতাকে বাস্তুচ্যুত করা শুরু হয়েছিল। ফাঁকা বাড়িগুলোর ছাদ-ছাউনিও খুলে দেওয়া হয়েছিল। আকাশপথে টহল দিয়েই যাতে বোঝা যায়, কোনও বাড়িতে কেউ লুকিয়ে রয়েছে কি না।
খাইবার-পাখতুনখোয়া নামে একটি এলাকা রয়েছে পাকিস্তানে। স্থানীয় জনতা নিজেদের পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করেন না। পাখতুন বা পাশতুন জনতার দীর্ঘদিনের আন্দোলন আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবিতে।
পাক সেনার গোলাগুলি খাইবার-পাখতুনখোয়াকেও রক্তাক্ত করছে রোজ। কালাশনিকভ, গ্রেনেড, মর্টার, হাউইৎজারের সেই ঘন ঘন গর্জনেও কিন্তু চাপা থাকছে না প্রতিবাদের স্বর।
এ সব নিয়ে ভাবার সময় অবশ্য এখন নেই পাকিস্তানের। পাক সরকার আজ কাশ্মীরের জন্য কালা দিবস পালনে ব্যস্ত। ভারতীয় অঙ্গরাজ্য যে ভাবে উত্তপ্ত এখন, নওয়াজ শরিফরা তাতে ‘বিহ্বল’। কাশ্মীরের পাশে দাঁড়াতে তাই আজ মহা আয়োজন সীমান্তপারে। ভারত থেকে কাশ্মীর যাতে বিচ্ছিন্ন হতে পারে, তার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগের শপথ নেওয়ার দিন আজ। ভারতের ‘দমন নীতি’র বিরুদ্ধে, মানবাধিকারের ‘ভূলুণ্ঠন’-এর বিরুদ্ধে এক হয়ে সংহতির বার্তা দেওয়ার দিন আজ।
সাধু উদ্যোগ সংশয় নেই। কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, রাষ্ট্রীয় দমন চললে, পীড়িতের প্রতি সংহতি ব্যক্ত করাই উচিত। কিন্তু এই সংহতির বার্তা কার তরফ থেকে? মানবাধিকার নিয়ে সওয়াল কার কণ্ঠে? মানবাধিকার আর গণতন্ত্র হরণের জেরে যে রাষ্ট্র ৪৫ বছর আগেই ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছে, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে। নিদারুণ পীড়ন চালিয়ে, অবিরাম রক্ত ঝরিয়ে বিভিন্ন অনিচ্ছুক, বিদ্রোহী জনজাতিকে বন্দি রাখতে সদা তৎপর যে রাষ্ট্র, তার সরকারের কণ্ঠে। মানবাধিকারকে, জনমতকে, গণতন্ত্রকে সত্যিই গুরুত্ব দিলে যে দেশটা এখনই আরও চারটি খণ্ডে ভেঙে যেতে পারে, সেই দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কণ্ঠে।
নিজের ঘরটা আগে গুছিয়ে নিন নওয়াজ। তার পর না হয় প্রতিবেশীর ঘর ‘সাজানো’য় মন দেবেন। পরিবারের অশান্তিটাই মেটাতে পারছেন না আপনি। কাশ্মীরের সুরাহা কী ভাবে করবেন? আর মানবাধিকার, জনমত, গণতন্ত্রের শিক্ষা নয়াদিল্লিকে দেওয়ার আগে, বালুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তান, খাইবার-পাখতুনখোয়ায় সযত্নে রক্ষিত আয়নাগুলোতে এক বার নিজের মুখটা দেখে আসুন। ঢাকাতেও একটা আয়না ছিল মনে রাখবেন। আপনার মতো আপনার পূর্বসূরিরাও সেই আয়নাটায় নিজেদের মুখ দেখতে চাননি। তাই ওখানে আপনাদের জন্য এখন আর কোনও আয়না অপেক্ষায় নেই। রয়েছে শুধু একটা ভয়ঙ্কর অতীত। কাশ্মীর নিয়ে ব্যাকুল হতে গিয়ে বালুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তান, খাইবার-পাখতুনখোয়ার নামটাও তেমন কোনও অতীতের খাতায় লিখিয়ে ফেলবেন না আশা করি।