চলছে পুতুলের বিয়ে। শিলচরের মাদ্রিপারে। ছবি: বকুলচন্দ্র নাথ।
পুরনো কাপড় দিয়ে পুতুল কে না বানায়! খেলাঘরে ওইসব পুতুলের বিয়েও হয়। মাটির ভাত, পাতার সবজি, কাগজের পাপড়— কত রান্নাই না করে শিশুরা। কিন্তু তাই বলে পুতুল বিয়েতে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে গোটা পাড়া! এমনটাই হল কাছাড় জেলার মাদ্রিপারে।
বাঁশকান্দি থেকে পালইবন্দের দিকে অনেকটা এগোনোর পর মাদ্রীপারের রাস্তা। এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি সেখানে। তা হলে কী? বিয়ের দিনে সৌর আলোর ব্যবস্থা করলেন গ্রামবাসীরা। বাজনা, মিষ্টি— বাদ যায়নি কিছুই।
প্রতি বছর এই উৎসবে মেতে ওঠেন এলাকার ছেলে-বুড়ো সবাই। কেউ বলেন, ‘‘তেনার কইনা ভাসানো।’’ কেউ বলেন, ‘‘তেনার কইনার বিয়া।’’ তেনা শব্দের অর্থ ন্যাকড়া বা পুরনো ছেড়া কাপড়। এই তেনার কনের শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়া বা নদীর জলে ভাসানোর নির্দিষ্ট তিথি রয়েছে। বৈশাখ মাসের শেষ দিনে বা বৈশাখ সংক্রান্তিতে কলার খোল দিয়ে তৈরি নৌকোয় বর-কনেকে বসিয়ে তাতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। পরে তা নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
এ বারও মাদ্রীপারে উৎসব শুরু হয়েছে বৈশাখ সংক্রান্তির দু’দিন আগে। সবাই মিলে স্থির করে নেন, কার বাড়ির বর, কোন বাড়ির কনেকে বিয়ে করবে। বরকর্তার অবশ্য এই বিয়েতে কোনও ঝামেলা নেই। পুরো অনুষ্ঠান হয় কনের বাড়িতে। উৎসবে মূল ভূমিকা নেয় পাড়ার অবিবাহিত তরুণী এবং শিশুরা। তারাই কাপড় দিয়ে দু’টি পুতুল তৈরি করে। বর-কনের বেশে তাদের সাজিয়ে তোলা হয়। এই বছর বর ছিল স্বপন শুক্লবৈদ্যর বাড়িতে। কনে নৃপেন্দ্র নমঃশূদ্রর বাড়ির।
উৎসবের প্রথম দিনে স্থানীয় বিবাহ-আচারের সঙ্গে যুক্ত নীতিনিয়মগুলি পালন করা হয়। দুই বাড়িতেই হয় মঙ্গলাচরণ, আদ্যস্নান ও অধিবাস। পর দিন বিয়ে। এলাকাবাসীর একাংশ আগেই স্বপনবাবুর বাড়ি গিয়ে বসে থাকেন। রাতে বাজনা পৌছনোর পর সবাই বরকে নিয়ে রওনা হন। সমারোহপূর্ণ মিছিলই বলা চলে। সবাই ছিলেন বিয়েবাড়ির সাজে। গ্রামের নানা পথঘাট ঘুরে বর গিয়ে পৌঁছন কনের বাড়িতে। কনেপক্ষের লোকজন গেট আটকে দিলে একপ্রস্ত হাসি-তামাশা হয়। এলাকাবাসীই কুঞ্জ সাজান, আলপনা আঁকেন নৃপেন্দ্রবাবুর উঠোনে। সেখানে সাতপাক হয় বর-কনের। হয় মালা-বদল। মিষ্টিমুখও।
বৈশাখ সংক্রান্তিতে বাসি-বিয়ে। মজাতেই সময় কাটে প্রথম দিকে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ওই দিন কনে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যায়। পুতুলকনেরও শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়ার সময় যত এগিয়ে আসে বিষাদে ছেয়ে যায় গোটা তল্লাট। পাড়ার মহিলারা বিচ্ছেদের গান ধরেন। কলার খোলের নৌকোয় বর-কনেকে বসানো হয়। কারও মুখে শব্দ নেই। সন্ধ্যা নামতেই প্রদীপ জ্বালিয়ে তাদের নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এ যেন পাড়ার সকলের স্নেহের মেয়েটির বিদায়-ক্ষণ।
মুল অনুষ্ঠানটিতে ছেলে-মেয়ের মা-বাবার দায়িত্ব শিশুরাই পালন করে। সমান তালে তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও অংশ নেন উৎসবে। তাঁদের বিশ্বাস, এটি শিব-গৌরীর বিয়ে। করিমগঞ্জের সুপ্রাকান্দি এবং লক্ষ্মীপুর মহকুমার রাজাবাজারেও এই উতসব পালিত হয়।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক অফিসার বকুলচন্দ্র নাথ জানান, বদরপুরের কাছে শ্রীগৌরীতে তাঁদের মূল বাড়ি। ছেলেবেলায় সেখানেও ‘তেনার কইনা ভাসানো’ উৎসব হতো। তবে সেখানে মাদ্রীপারের মত তিন দিনের অনুষ্ঠান নয়। বৈশাখ সংক্রান্তিতে বিকেলে বিয়ে হতো, আর রাতেই কনেকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। ‘তেনার কইনা ভাসানো’ উৎসব দেখতে বকুলবাবুও এ বার গিয়েছিলেন মাদ্রীপারে। বললেন, ‘‘সময়ের পরিবর্তনে এখন সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। গ্রামের সবাই ভুজিয়া-বুঁদে খেয়েছেন। শ্রীগৌরীতে চিড়া-খই-বাতাসা দেওয়া হতো। জলে সাতার কেটে আমরা বাতাসা ধরতাম।’’
গত বছরের ফাল্গুন মাসে মাদ্রীপারে বিয়ে করেছেন শিলচরের নারায়ণ সরকার। বিয়ের রাত থেকেই মুখে মুখে শুনছেন ‘তেনার কইনা ভাসানো’র কথা। এ বার তাই বৈশাখ সংক্রান্তি মাদ্রীপারেই কাটান। তাঁর কথায়, ‘‘এ যে দেখছি একেবারে আমাদের বিয়ের মতোই! বাজনা বাজছে, বাজি পুড়ছে।’’
বৈশাখ সংক্রান্তিতে এই বিয়ে হলেও ময়মনসিংহ থেকে বরাক উপত্যকা পর্যন্ত শিব-গৌরীর বিয়ের আরেক অনুষ্ঠান হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে। তাকে বলে বুড়াই-বুড়ির পুজো। বৃহত্তর বঙ্গেও শিবগৌরীর বিয়ের অনুষ্ঠান প্রচলিত রয়েছে। নবদ্বীপে চৈত্র মাসের শুক্লা দশমীর শেষ রাতে ঘটা করে শিবের বিয়ে হয়।
এই বিয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি সংস্কার জড়িত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা দামী দামী জিনিস নিয়ে মণ্ডপে সাজিয়ে রাখেন। তাদের বিশ্বাস, এতে তাঁদের বিক্রি ভাল হয়। পরে যদিও জিনিসগুলি তারা ফিরিয়ে নিয়ে যান।
শিবগৌরীর বিয়েকে উপজীব্য করে দক্ষিণ ভারতেও নানা রকমের উৎসব প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীন ভাস্কর্যেও শিব-শিবাণীর বিয়ের নানা দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
লোকগবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘’সামাজিক পটপরিবর্তনের ফলে লৌকিক উৎসবগুলি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় উপাদান ব্যবহার করে আমরা এখনও ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করছি। ‘তেনার কইনা ভাসানো’র মত লৌকিক উৎসবগুলিকে যদি যথাযথ ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি, তা হলে ইতিহাস রচনার একটি ভারতীয় রীতি উদ্ভাবন করতে পারি।’’