দুই যুবাকে ঘিরেই উচ্ছ্বাস

এই সেই আনন্দ ভবন। ওই দোতলার দখিনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু বার কর্মী-সমর্থকদের সম্বোধন করেছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। দোতলায় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হতো যে ঘরটিতে, ঠিক তার পাশেই ইন্দিরার ঘর। একটা ছোট্ট বিছানা। মাথার কাছে রাখা রামকৃষ্ণ, সারদামণি ও আনন্দময়ীর ছবি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

ইলাহাবাদ শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৫
Share:

ফাইল চিত্র।

এই সেই আনন্দ ভবন।

Advertisement

ওই দোতলার দখিনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু বার কর্মী-সমর্থকদের সম্বোধন করেছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। দোতলায় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হতো যে ঘরটিতে, ঠিক তার পাশেই ইন্দিরার ঘর। একটা ছোট্ট বিছানা। মাথার কাছে রাখা রামকৃষ্ণ, সারদামণি ও আনন্দময়ীর ছবি।

এই মুহূর্তে সেই আনন্দ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাহুল গাঁধী আর অখিলেশ যাদব। ঠাকুমার ঘরটি তার আগে এক বার চুপিচুপি দেখে এসেছেন রাহুল। দু’জনেই এখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন জিপের ওপর। আশেপাশের বাড়ি থেকে ফুল ছুঁড়ছেন মানুষ, মালাও। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে দু’জনের নামে। অখিলেশের মাথায় লাল সমাজবাদী টুপি। রাহুলের গলায় তেরঙ্গা উত্তরীয়। দুপুর দুটোর ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরেও দু’জনকে ঘিরে মানুষের সমুদ্র। শাঁখ বাজাল লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা।

Advertisement

মিছিল এগোল। যেন শুরু হয়ে গেল বসন্ত উৎসব। হোলির তো বেশি দেরিও নেই। আনন্দ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে একটা ‘শুদ্ধ শাকাহারী’ ভোজনালয়। তার সামনে হাতে দুটো গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার ছাত্র মনোজ শ্রীবাস্তব। ধুলিধূসরিত চটি, কাঁধে ঝোলা। ভিড় ঠেলে হাতের গোলাপ দু’টি প্রাণপণে রাহুল আর অখিলেশের হাতে তুলে দিতে চাইছিল মনোজ। চিৎকার করে বলছিল, ‘‘রাহুল ভাইয়া, অখিলেশ ভাইয়া!’’ ঠিক যেন সিনেমা।

মাথা বাঁচিয়ে। জিপের উপরে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে রাহুল গাঁধী। মঙ্গলবার ইলাহাবাদে রোড-শো। ছবি: পিটিআই।

রাহুল দেখতে পাননি মনোজকে। অখিলেশ দেখাতে রাহুল ইশারায় ডাকলেন তাকে। এসপিজি-পুলিশের ঘেরাটোপ টপকে শেষ পর্যন্ত মনোজ তার গোলাপগুচ্ছ তুলে দিতে পারল ভালবাসার নেতাদের হাতে।

মনোজের বাড়ি গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম তীরে দেবরাহ গ্রামে। প্রয়াগের ভূমিপুত্র মনোজ এখন থাকে আনন্দ ভবন থেকে দু’কিলোমিটার দূরে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। বাবা নিম্নমধ্যবিত্ত সরকারি কর্মচারী। গোলাপ দিতে পারার সাফল্যে উৎফুল্ল মনোজ বললেন, ‘‘এখানে কে জিতবে জানি না। কিন্তু আমরা বহু ছাত্রই এই যুব জুটিকে ভোট দিচ্ছি। কারণ একটাই— ইলাহাবাদ নগরী আবার তার হৃতগৌরব ফিরে পাক। আমরা সবাই চাকরি-বাকরি পাই!’’

আনন্দ ভবন তো নিছক বাড়ি নয়। মতিলাল নেহরু থেকেছেন, নেহরু-ইন্দিরা থেকেছেন। ইন্দিরার বিয়ে হয়েছে এখানে। রাজীবের জন্ম এই বাড়িতে। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়ে ব্রিটিশ শাসকরা এই বাড়ি বাজেয়াপ্ত করে। এই সেই বাড়ি। আধুনিক ইতিহাসের এক নয়া মোড়ের নীরব সাক্ষী। রায়বরেলীতে জনসভা সেরে রাহুল আজ আনন্দ ভবন সংলগ্ন স্বরাজ ভবনের ঘরে উঠলেন। ইলাহাবাদে এলে এখানেই থাকেন তিনি। অখিলেশও এলেন। লম্বা আড্ডা হল দু’জনের। নেহরুর নাতির ছেলে বললেন— ‘‘এই বাড়িকে সাক্ষী রেখে আজ আবার আমরা এক নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছি!’’

আরও পড়ুন: দাদা কে, পুরভোটে বোঝাবে মহারাষ্ট্র

সকাল থেকেই শহরে উত্তেজনা। ভোট প্রচারের শেষ দিন। এই ‘রোড শো’য়ের পাশাপাশি একই সময়ে আল্লাপুর থেকে ঘণ্টা ঘর পর্যন্ত চলেছে অমিত শাহর ‘রোড শো’। তবে একটা বিষয় দিবালোকের মতো স্পষ্ট— বিজেপির এখানে এখনও দাপট আছে। অমিত শাহর ‘রোড শো’য়েও মানুষ আসেনি তা নয়। কিন্তু রাহুল-অখিলেশের ‘রোড শো’য়ে স্বতঃস্ফূর্ততা যেন অনেক বেশি। নতুন জুটির কাছে নতুন প্রত্যাশা। যুব সমাজের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সব চেয়ে নজরকাড়া অভিনব দৃশ্য অখিলেশ-রাহুলের অনুষ্ঠানে— সর্বত্র কংগ্রেস আর সমাজবাদী পতাকা পাশাপাশি। অখিলেশের লাল সবুজ মিছিলে রাহুলের ছবি। রাহুলের গেরুয়া সবুজ মিছিলেও ছবিতে অখিলেশ। মিছিলে আছে জুটির ছবি লাগানো ভ্যান। তাতে লেখা— ‘জনতাকো ইয়ে জোড়ি পসন্দ হ্যায়’। আনন্দ ভবন, ইউনিভার্সিটি চৌরাহা, মনমোহন পার্ক, সেখান থেকে সার্কুলার রোড দিয়ে পত্থর গির্জা ঘর। গোলপার্কে এসে শেষ হল যাত্রা। ভিড়ের চরিত্রে ফারাক ছিল নানা স্থানে। কিন্তু ভিড়ের ঘাটতি ছিল না কোথাও।

বিকেলের মিঠে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে। একটা করে চিকেন স্যান্ডউইচ খেয়ে সারা দিন ছিলেন দু’জন। দু’জনেই ঘামছিলেন। মাঝে মাঝে সাদা রুমাল বার করে মুখ মুছছিলেন। আর দু’জনেই প্রচারটাকে তুঙ্গে নিয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদী নামক এক বহিরাগতের বিরুদ্ধে। ডিম্পল যাদব তো গত কালই এ শহরে বলেছিলেন, ‘মেরে অঙ্গনে মে তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়!’ আর আজ গঙ্গা-যমুনা জুটি বললেন, ‘‘আমাদের দু’জনেরই শেকড় এ রাজ্যে। আর উনি বলছেন উনি নাকি পালিত সন্তান! জুলুমবাজিতে সাফল্য দেখিয়েছেন, কাজে লবডঙ্কা!’’ স্থানীয় সপা বিধায়ক আর নেতারা এই বিষয়টিকে আজ প্রচারের তুঙ্গে নিয়ে গেছেন। তাঁরা বলছেন— দুই গুজরাতি এসে ইলাহাবাদের শান্তি বিঘ্নিত করছেন। আমরা সেটা হতে দেব না।

এক সময়ে ইলাহাবাদের উচ্চবর্ণ ছিল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর মানুষ কংগ্রেস থেকে মুখ ফেরায়। আজও কংগ্রেসে ফেরেনি সে ভোট। আনন্দ ভবন থেকে যাত্রা শুরু করে আজ সেই হৃতগৌরব ফেরানোর শপথ নিলেন রাহুল। দুই নেতাই আজ বার বার বলছেন, ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম স্থলকে তাঁরা খুনের শহর হতে দেবেন না।

ইলাহাবাদের মানুষ কী বলেন, সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন