নিজস্ব চিত্র
আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ! রাত আটটা থেকে বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান…!
অটোর মাথায় চোঙার আওয়াজে পিলে চমকায়। যে রাজ্যে হিন্দিই হাজার বার হোঁচট খায়, সেখানে কি না বাংলায় জলসার সংবাদ!
নদীয়ার গৌরাঙ্গ হালদারের মুখে হাসি খেলে যায়। মোবাইলে বাংলা গান ভরা, গ্রামে টাকা পাঠানোর কাজ শেষ। এ বার ফুর্তির পালা। মুর্শিদাবাদের ইসফাক আহমেদ লুঙ্গি আর গোটা হপ্তার বিড়ির প্যাকেট কিনে হাঁটা লাগান ‘সান সাইন’ হোটেলের দিকে। বাংলা হরফে যেখানে সগর্ব ঘোষণা, ‘এখানে ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডাল, সব্জি, দই, মিষ্টি, ক্ষীরমালাই পাওয়া যায়।’ বাইরে টিনের ট্রাঙ্ক, রসগোল্লা-ল্যাংচার পাশেই বিক্রি সর্ষের তেলের। বাঙালি পেটে কাহাতক আর নারকেল তেলে রান্না সহ্য হয়! বাজারের দোতলায় ‘কলকাতা টিকিট’-এর হাতছানি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আশ্চর্য ভ্রমণের খবর— ‘কেরল থেকে জলঙ্গি বাস, টিকিটের জন্য যোগাযোগ করুন’।
কোচি থেকে অঙ্গামালি যাওয়ার হাইওয়ে ধরে ৪০ কিলোমিটার গেলেই পেরুমবাভুরে গাঁধী মার্কেটের অলিতে-গলিতে এমনই চমক। এর্নাকুলাম জেলার এই ছোট্ট শহর ও আশেপাশে শ’য়ে শ’য়ে প্লাইউড কারখানা, কাঠকল, আসবাব তৈরির কারখানা ও আড়ত। রয়েছে কাপড়ের কারখানাও। সেখানে কাজ করতে আসা গৌরাঙ্গ-ইসফাকদের দাপটে বাজারের একটা অংশের নামই হয়ে গিয়েছে ‘বাঙ্গালী মার্কেট’। মোবাইলের দোকানের হোর্ডিংয়ে মালয়ালির পাশে বাঙালি হরফ। সিডি-র মোড়কে মামুট্টিকে সরিয়ে পাগলু-ড্যান্স দেবের। সরকারি হিসেবে, গোটা কেরলে ভিন্ রাজ্যের শ্রমিক প্রায় ২৫ লক্ষ। তার মধ্যে পেরুমবাভুরেই লাখ দেড়েকের বেশি।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অসম-ওড়িশা-বিহারের খেটে খাওয়া মানুষও রয়েছে এই তালিকায়। কিন্তু আর সব রাজ্য বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গৌরাঙ্গ-ইসফাকরাই এ বার কেরলের ভোটে রাজনীতির ঘুঁটি হয়ে উঠেছেন। নিজেদের অজান্তেই। এ রাজ্যের ভোটার না হয়েও।
বিজেপি তো বলছেই, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম রাজত্বে এমন করুণ হাল হয়েছে যে লোকে পেট চালাতে কেরলে ছুটে আসছে। বাদ নেই কংগ্রেসও। প্রচারে তারা বলছে, উমেন চান্ডির পাঁচ বছরে উন্নয়নের কাজ হয়েছে। রোজগারের সুযোগ বেড়েছে। তাই মানুষ বাংলা ছেড়ে কেরলে চলে আসছে। তিন দশক ক্ষমতায় থেকেও বাম সরকার সে রাজ্যের মানুষের জন্য কিছুই করেনি।
সিপিএম দুষছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পলিটব্যুরোর নেতা হান্নান মোল্লার দাবি, গত চার-পাঁচ বছরে রাজ্যের বাইরে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ দোষ তৃণমূল জমানার। বাঙালি নেতারা সচরাচর কেরলে প্রচারে ডাক পান না। হান্নান ব্যতিক্রম। আলেপ্পি-কোল্লাম-মালাপ্পুরমে প্রচারের ফাঁকে দেখা হতে হান্নানের অভিযোগ, ‘‘একশো দিনের কাজ থেকে আয় কমে গিয়েছে। ফসলের দাম মিলছে না ঠিকমতো। লোকে তাই কাজের খোঁজে ভিটে ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।’’
সব দলের নেতারাই মানছেন, ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকদের নিয়ে কেরলে কিন্তু কোনও সামাজিক সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, কেরলের শ্রমিকদের সিংহভাগই আরব দুনিয়ায়। ফলে গায়েগতরে খাটার লোকের অভাব এখানে। সেই অভাব মিটিয়ে দিচ্ছে মেদিনীপুর-মুর্শিদাবাদ। মালয়ালিরা বিদেশে খেটে দেশে টাকা পাটাচ্ছে। বাঙালিরা কেরলে কাজ করে নিজের সংসার চালাচ্ছে। এমনিতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সিপিএমকে দুষতে কংগ্রেস-বিজেপি ভোটের প্রচারে এই প্রসঙ্গ টেনে তুলতেও ছাড়ছে না।
এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন জলঙ্গির ইউনুস আলি বিশ্বাস। বছর চৌত্রিশের দোহারা চেহারা। ছ’বছর দিল্লির পঞ্জাবি বাগে ফলের রস বানাতেন। তার পর কেরলে এসে হাতে নিয়েছেন করাত। দৈনিক মজুরি বেশি। প্লাইউডের কারখানা হোক বা রাজমিস্ত্রির কাজ, দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বাঁধা। থাকাখাওয়ার খরচ কম, তাই গ্রামে টাকাও বেশি পাঠানো যায়। তা দিয়েই কাজিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে পাকা ঘর উঠছে। শুধু মাঝেমাঝে ভয় হয়, অনেকেই বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে বলে। পুলিশের ঠেলায় প্লাইউড কারখানার মালিক আই-কার্ড বানিয়ে দিয়েছেন। তা-ও ভয় যায় না। রাজনীতি চুলোয় যাক। ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই হল। নাম কেটে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই এ বার রাজ্যে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন। কথাটা জানিয়ে পেরুমবাভুরের ভিড়ে মিশে যান জলঙ্গির ভোটার। বর্তমানে কেরলের এক ভোটের ঘুঁটি।