দিল্লির এআইসিসি কার্যালয়।
উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের আগে বিহার-দিল্লির ক্ষত মিটিয়ে যে সঞ্জীবনী বটিকাটি দরকার ছিল, আজকের বিধানসভার ফল তা তুলে দিল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের হাতে। আর দুই রাজ্য হারিয়ে, আরও দুই রাজ্যে জোটের পরাজয়ে প্রশ্ন উঠে গেল রাহুল গাঁধীর নেতৃত্ব নিয়েও। মোদী-বিরোধী জোটও এখন ভয় পাচ্ছে কংগ্রেসকে ছুঁতে।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয় হলেও কংগ্রেস ও বাম জোটের হার, তামিলনাড়ুতে আম্মার জয়ের ফলে ডিএমকে-কংগ্রেসের হার, আর কেরল-অসম কংগ্রেসের হাতছাড়া হওয়ার ফলে সার্বিক ভাবে নিজেদেরই জয় দেখছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশকে ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ করার যে স্লোগান দিয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যেই আরও এক ধাপ এগোনো গেল বলে আজ দাবি করলেন মোদীর সেনাপতি অমিত শাহ। ফলে দিল্লি ও বিহার বিধানসভার ভরাডুবির পর দলের কর্মীদের মনোবলে যে আঁচ পড়েছিল, আজ সেই ক্ষত অনেকটাই মেরামত হল। বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের আগে কর্মীদের মনোবল বাড়াতে এটি সাহায্য করবে। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সাফল্য নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। সরকারের দুই বছর পূর্তির মুখে আজকের ফলের পর এ বার ধুমধাম করে মোদী সরকারের সাফল্য মেলে ধরা হবে।
অসম ছাড়া কোনও রাজ্যেই সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখেনি বিজেপি। কিন্তু এ বারে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল বিধানসভায় যে ভাবে বিজেপি পা রাখার সুযোগ পেল, সেটিই বড় জয় দেখছে দল। কারণ, এত দিন বিজেপি মূলত গো-বলয়ের দল হিসেবেই পরিচিত ছিল। কর্নাটকে এক বার ক্ষমতা দখল করেও পরে তা হাতছাড়া হয়েছে। ফলে চিরাচরিত ভাবে অ-বিজেপি রাজ্যে পা ফেলতে পেরে খুশির হাওয়া বিজেপি শিবিরে। বিহার নির্বাচনের পর বাড়ির বাইরে বেরোননি অমিত শাহ। কিন্তু আজ বাড়ির বাইরে পা রেখে হাসিমুখে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। সকাল থেকে টুইটে অভিনন্দনের বন্যায় ছয়লাপ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও।
যে কংগ্রেসকে দুই রাজ্যে উৎখাত করতে দেখে বিজেপির এত উল্লাস, সেই দলের নেতা রাহুল গাঁধী অবশ্য আজ টুইটে হার স্বীকার করে নেন। ভবিষ্যতে আরও মেহনত করে মানুষের আস্থা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু আজকের পরাজয়ের পর দলের মধ্যেই রাহুলের নেতৃত্বে প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। কারণ, অসম-কেরল হাত থেকে তো ফস্কে গেলই, পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোটেও সায় দিয়েছিলেন রাহুল। নীতীশ কুমারের শপথ অনুষ্ঠানে মমতা নিষেধ করা সত্ত্বেও। দু’দিন আগে দিল্লি পুরসভার চারটি আসন জিতে দল যে ভাবে রাহুলের জয়ধ্বনি করছিল, আজ দল যথারীতি রাহুলকে বাঁচানোর চেষ্টায় নেমেছে। তবু দলের নেতা শশী তারুর প্রকাশ্যেই দাবি তুলেছেন, এ বারে দলের কেন্দ্রীয় সংগঠনে রদবদল করা উচিত।
যদিও দলের পক্ষ থেকে রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে রাহুলের কোনও ভূমিকা নেই। রাজ্য নেতৃত্বের কোথায় গরমিল ছিল, সেটি পর্যালোচনা করা হবে।’’ মুখে এ কথা বললেও কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কা, এ বারে মোদী-বিরোধী গোষ্ঠীর মুখ হওয়া থেকেও ক্রমশ ছিটকে পড়ছেন রাহুল গাঁধী। ক’দিন আগেও পরের লোকসভায় রাহুলের মোকাবিলায় নিজেকে এগিয়ে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। এখন যদিও মমতা থেকে জয়ললিতা— অনেকেই সেই দৌড়ে সামিল হওয়ার দাবি তুলতে পারেন। কিন্তু কংগ্রেস বুঝতে পারছে, একের পর এক বিপর্যয়ের পর এ বারে কংগ্রেস ধীরে ধীরে অচ্ছুৎ হয়ে পড়ছে। অসমের এইউডিএফ নেতা বদরুদ্দিন আজমল আজ বলেই ফেলেছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে যে যাবে, তার পতন অনিবার্য।’’
কংগ্রেসের এই ‘সর্বনাশে’ বিজেপি নিজেদের ‘পৌষ মাস’ দেখছে। কংগ্রেসের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে তাই আরও বেশি করে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন অমিত শাহরা। নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন বাস্তবে দেখা যায় না বলে যে অভিযোগ উঠছে, তার দায়ও সুকৌশলে ঠেলে দিলেন কংগ্রেসের ঘাড়ে। এই কৌশলে ভর করে মোদীর দু’বছরের কাজেও শিলমোহর বসিয়ে নিতে চাইছে বিজেপি। দিল্লি ও বিহারের হারের পর আজকের জয়ে অমিত শাহও দলে নিজের সাংগঠনিক কর্তৃত্ব আরও শক্ত করতে ফেলার সুযোগ পেলেন। সঙ্ঘ অতীতে তাদের নেতাদের মুখ করার দাবি তুলত। কিন্তু এ বারে সঙ্ঘের বাইরের ব্যক্তি সর্বানন্দ সোনোয়ালকে অসমের মুখ করে, এমনকী কংগ্রেস থেকে আসা শক্তিশালী নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে গুরুত্ব দেওয়ার কৌশল কাজ দিয়েছে। অ-বিজেপি রাজ্যে বিস্তার ঘটাতে এনডিএ-কেও যে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে, সেটিও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ফলে সব মিলিয়ে সঙ্ঘকেও কিছুটা প্রশমিত করতে পেরেছেন অমিত শাহ।
কিন্তু আসল পরীক্ষা যে এ বারে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, হিমাচল, মায় মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতও, সেটি ভাল ভাবেই জানেন মোদী-শাহ। অমিত শাহ আজ বলেন, ‘‘যে ভাবে বিজেপি তাদের সংগঠন কেরল থেকে কাশ্মীর, কচ্ছ থেকে কামরূপে বিস্তার করতে পারছে, সেটি পরের নির্বাচনগুলির ভিত। এমনকী, ২০১৯ সালের লোকসভাতেও এর সুফল পাওয়া যাবে।’’ বিহার নির্বাচনের পর লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশীরা বিদ্রোহ করে প্রধানমন্ত্রী, অমিত শাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মোদীদের এ বারের বাড়তি প্রাপ্তি জোশীর থেকে একটি তারিফের চিঠি। মোদীকে অভিনন্দন জানিয়ে জোশী এ বারে চিঠি লিখেছেন, আশা করি এই ফলের পর উত্তরপ্রদেশে কর্মীরা আরও উজ্জীবিত হবে।