কে বললে ছাতি চুপসে না কি ২৬ ইঞ্চি হয়েছে? এত দিন যাঁরা গাল পাড়তেন, এই দেখুন ৫৬ ইঞ্চি ছাতির জোর।
সকালে টেলিভিশনের পর্দায় যখন মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকের ছবি ভেসে উঠল, তখন থেকেই সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া। এই বুঝি যুদ্ধ ঘোষণা হল। ঘন্টাখানেক পর সেনা যখন ঘোষণা করল, কাল রাতেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে ভারতীয় সেনা জঙ্গি দমন করেছে, তার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদীর ৫৬ ইঞ্চি ছাতির জোরের ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছে। যুদ্ধ যে এখনই হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী আগেই ঘোষণা করেছেন। কিন্তু অন্তত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান হোক, সরকারের থেকে এই ঘোষণাটিই শুনতে চাইছিলেন আক্রোশে ভরা দেশবাসী।
আজ সেই কথাটিই দেশবাসীকে শুনিয়ে ছাতির জোর দেখালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এত দিন নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে হামলা হলেও তা কবুল করা হত না। আজ সেটিই গোটা বিশ্বের সামনে বুক দাপিয়ে বললেন। রাইসিনা পাহাড়ের উপরে সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর তার পাশেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে ডিজিএমও কাল রাতের সেনা অভিযানের কথা বলতে পারতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই হামলার কথাটি বুক দাপিয়ে সজোরে শোনাতেই চাইছিলেন গোটা দুনিয়াকে। আর তাই রাইসিনা পাহাড় থেকে নেমে সাংবাদিক বৈঠক হল বিদেশ মন্ত্রকের দফতর জওহরলাল নেহরু ভবনে।
সাধারণত, মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠক কখন হয় টের পাওয়া যায় না। কী কথা হয়, ঘুণাক্ষরেও তা প্রকাশ্যে বলা হয় না। কিন্তু আজ বেনজির ভাবে নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির ছবিও প্রকাশ করা হল। উরির ঘটনার পর যে পাহাড়প্রমাণ বোঝা মাথায় নিয়ে চলছেন প্রধানমন্ত্রী, সেনার সফল অভিযানের পর পাকিস্তানকে কঠোর বার্তা দিতে পেরে তাঁর নিজের সঙ্গে লড়াইতেই জয়ী হলেন অনেকটা। আর এই মেগা-ইভেন্টে যাতে কোনও ফাঁকফোকডর না থাকে, তার জন্য সকাল থেকেই বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়েছেন সেনা অভিযানের সাফল্য-গাথায়। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির পাশাপাশি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ফোন করে গোটা ঘটনা জানিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠিয়েছেন সনিয়া গাঁধীর কাছে। আর বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সর্বদল বৈঠক ডেকে সেনা অভিযানের কথা জানিয়েছেন সবিস্তারে।
যার ফলও মিলেছে হাতে নাতে। অরবিন্দ কেজরীবাল সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেও পিছিয়ে এসেছেন। সকাল থেকে মোদী সরকারকে দুষতে দু’দফায় সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিল কংগ্রেস। কিন্তু পাকিস্তানকে কড়া বার্তা দিয়ে সেনাদের পাশে দাঁড়াতে আজ সরকারের তারিফই করতে হল সনিয়া গাঁধীকে। মনমোহন সিংহ, প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একে অ্যান্টনি, আহমেদ পটেল, গুলাম নবি আজাদের সঙ্গে বৈঠক করে সনিয়া গাঁধী একটি বিবৃতিও জারি করেন। সেখানে তিনি বলেন, সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসের জবাব দিতে ও দেশের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে সেনা অভিযানের বিষয়ে সরকারের পাশে আছে কংগ্রেস। অনুপ্রবেশ ও হামলার জবাবে এটি কড়া বার্তা। এর পর পাকিস্তান নিশ্চয়ই নিজেদের জমিতে সন্ত্রাসের কাঠামো ভাঙ্গতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।
দু’বছরের মাথায় লোকসভা নির্বাচন তো আছেই। সামনে উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগেও এমন একটি পরিমণ্ডলই দরকার ছিল নরেন্দ্র মোদীর। ‘অচ্ছে দিন’ দু’বছরেও আসেনি। তা নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ছে। অর্থনীতিও হোঁচট খাচ্ছে পদে পদে। এই অবস্থায় পঠানকোটের পর উরির ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোদের উপর বিষফোঁড়া। বিরোধী দলে থাকতে যে মোদী পাকিস্তানকে তাদের ভাষাতেই জবাব দেওয়ার হুঙ্কার দিতেন ৫৬ ইঞ্চির ছাতির জোরে, আজ তিনিই যুদ্ধের বদলে পাকিস্তানের সঙ্গে গরিবি-হটাও লড়াইয়ের কথা বলছেন। যখন আরএসএস থেকে তাঁরই দলে আসা নেতা রাম মাধব উরির ঘটনার পরেই ‘দাঁতের বদলে চোয়াল’ খুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বসে আছেন। আর সেটাই দেশের মুড।
জাতীয়তাবাদের আবেগে এই আক্রোশকে নিজের পালে টানতে সেনা অভিযান ছাড়া আর যে কোনও বিকল্প নেই, সেটি বুঝেই উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এটাই ছিল তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। কাল রাতে সেনাদের সফল অভিযানের পর আজ তাই সকাল থেকে এটিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারের কোনও পথ বাকি রাখেননি নরেন্দ্র মোদী। এমন একটি বিষয়ে বিরোধী দলগুলিরও বিরোধিতার কোনও অবকাশ নেই। আর এক ধাক্কায় দল ও সঙ্ঘকেও নিজের পাশে দাঁড় করালেন। সেনার পাশাপাশি তাই সকাল থেকে চলছে মোদীর জয়ধ্বনি।
আপাতত অ্যাডভানটেজ মোদী।
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বিধ্বস্ত জঙ্গিরা