সিপিএমে জোট-যুদ্ধ

বৈঠকে ইস্তফার কথা, পরে বহিষ্কার নেত্রীকে

সোমবার সকালে এ কে গোপালন ভবনের দোতলায় কেন্দ্রীয় কমিটির বিতর্কের শেষে তখন ভোটাভুটি চলছে। আলোচনায় সভাপতিত্ব করছেন মানিক সরকার। পাশে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রণকৌশল সম্পর্কে কী অবস্থান নেবে, তা নিয়েই ভোটাভুটি।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৬ ১০:০৮
Share:

জগমতী সঙ্গওয়ান

সোমবার সকালে এ কে গোপালন ভবনের দোতলায় কেন্দ্রীয় কমিটির বিতর্কের শেষে তখন ভোটাভুটি চলছে। আলোচনায় সভাপতিত্ব করছেন মানিক সরকার। পাশে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রণকৌশল সম্পর্কে কী অবস্থান নেবে, তা নিয়েই ভোটাভুটি।

Advertisement

হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন জগমতী সঙ্গওয়ান। বললেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আমি পদত্যাগ করতে চাই।’ সকলেই অবাক। মানিকবাবু তাঁকে বলেন, ভোটাভুটি হয়ে যাক। পরে এই বিষয়ে আলোচনা হবে।

তবে আর অপেক্ষা করেননি গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা। বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। বাইরে সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি ও দল থেকেও পদত্যাগ করছেন। কেন এই পদত্যাগ? জগমতীর যুক্তি, ‘‘কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্যই মত দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করাটা পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে ছিল। অথচ বাংলা নিয়ে পলিটব্যুরোর প্রস্তাবে পার্টি লাইন অমান্য করার কথা বলা হচ্ছে না। শুধু বলা হচ্ছে, ওই জোট সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। আমি এর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’’ স্বাভাবিক ভাবেই আলোড়ন, এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এসে যায় কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়ে দেয়, শৃঙ্খলাভঙ্গের দোষে জগমতীকে পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।

Advertisement

কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে সাম্প্রতিক অতীতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার বহিষ্কারের ঘটনা ঘটল। চার বছর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দলের রিসার্চ সেলের আহ্বায়ক প্রসেনজিৎ বসু পদত্যাগ করেন। তাঁকেও বহিষ্কার করা হয়। সে সময় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই শাখাও প্রতিবাদ করে। ভেঙে দেওয়া হয় গোটা শাখাটাই। সেটা ছিল প্রকাশ কারাটের জমানা। এ বার ইয়েচুরি জমানায় সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটল। আজ জগমতীর বহিষ্কারের পরে প্রসেনজিৎ বলেন, ‘‘যাঁরা পার্টি কংগ্রেসের লাইন ধরে রাখার কথা বলছে, তাঁদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নয়, পলিটব্যুরোর স্বৈরাচার।’’ ২০০৮-এ ইউপিএ-সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকার পদ ছাড়তে চাননি। তাঁকেও বহিষ্কার
করা হয়েছিল।

ইয়েচুরি অনুগামীরা মনে করছেন, জগমতীর বিদ্রোহে পলিটব্যুরোর এক নেত্রীর মদত রয়েছে। তিনিই জগমতীকে ইয়েচুরি-আলিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে উস্কেছেন। তাই বিতর্কের সময়ে আলিমুদ্দিনের পাশাপাশি ইয়েচুরির বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন জগমতী। প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁকে নাকি কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ইস্তফা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু হরিয়ানার নেত্রী জগমতী উত্তেজিত হয়ে পার্টি থেকেই পদত্যাগের কথা বলেন।

১৯৯৮-এ কলকাতায় পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন এই ভাবেই বিদ্রোহ করেছিলেন বৃন্দা কারাট। সে দিন নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যোগ দিতে অস্বীকার করেন বৃন্দা। মহিলা সংরক্ষণের পক্ষে কথা বলা সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বে মহিলাদের উপস্থিতি নেই কেন, সেই প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে কনক মুখোপাধ্যায়কে বাদ দেওয়ারও প্রতিবাদ জানান। হরকিষেন সিংহ সুরজিতের জমানায় বৃন্দার বিদ্রোহে বিপাকে পড়েছিল দল। তিনি অবশ্য দল বা মহিলা সংগঠন ছাড়েননি। আড়াই বছর পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরানো হয়। নিজের আচরণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন বৃন্দা। পরে আসেন পলিটব্যুরোতেও।

জগমতীর সেই সুযোগ জোটেনি। মৌখিক ভাবে পদত্যাগের পর এ কে গোপালন ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই কাঁদতে শুরু করে দেন তিনি। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা দলের নীতির বিরুদ্ধে!’’ কেন তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা হল না? ইয়েচুরি বলেন, ‘‘অন্য বিষয়ে আলোচনার মধ্যেই জগমতী পদত্যাগের কথা বলে বেরিয়ে যান। বাইরে গিয়ে বলে দেন। এটা শৃঙ্খলাভঙ্গ নয়? কেন পদত্যাগ তা-ও তিনি বলেননি।’’

তিরিশ বছর ধরে দলের সঙ্গে যুক্ত জগমতী প্রাণ বাজি রেখে হরিয়ানায় খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। দাপুটে নেত্রীকে একডাকে চেনে উত্তর ভারতের বহু গ্রাম। ভলিবলে এশিয়ান গেমসে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা জগমতী যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement