প্রশ্নের মুখে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব

ভোল পাল্টেছে বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়নের। এখন আর ভিড় নেই অফিস চত্বরে। নেতারা থাকলে তবু দু-চারজন যান। অন্য সময় খাঁ খাঁ করে বিশাল দালানবাড়িটি।

Advertisement

উত্তম সাহা

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

ভোল পাল্টেছে বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়নের। এখন আর ভিড় নেই অফিস চত্বরে। নেতারা থাকলে তবু দু-চারজন যান। অন্য সময় খাঁ খাঁ করে বিশাল দালানবাড়িটি।

Advertisement

ভোল পাল্টেছে ইউনিয়ন নেতাদেরও। এতদিন তাঁরা নির্বাচন এলেই বলেছেন, কংগ্রেসকে ভোট দিন। নির্বাচনী সভাও হতো অফিস প্রাঙ্গণে। এখন সনাতন মিশ্র, ব্রহ্মানন্দ কুর্মির মত নেতারা বলছেন, ‘‘আইএনটিইউসি নিয়ন্ত্রিত হলেও বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসি নয়। গত নির্বাচনে আমরা বাগান শ্রমিকদের নির্দিষ্ট করে কাউকে ভোট দেওয়ার কথাও বলিনি।’’

তাঁরা যা-ই বলুন, দীর্ঘদিন বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী, দীনেশপ্রসাদ গোয়ালা। দীনেশবাবুর মৃত্যুর পর আর এক মন্ত্রী অজিত সিংহ সাধারণ সম্পাদক হন। এ বার সাধারণ সম্পাদক অজিত সিংহ নিজে উধারবন্দ আসনে পরাস্ত হয়েছেন। বিধানসভায় বাগানের প্রতিনিধিত্বও বহুলাংশেই কমেছে। কংগ্রেস অধ্যুষিত বলে পরিচিত বাগানগুলিতেও এ বার ‘ভগওয়া ঝান্ডা’-র ব্যাপক দাপট দেখা গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গে সনাতনবাবুর খোলামেলা মন্তব্য, বাগান-শ্রমিকরা কংগ্রেসের কেনা গোলাম নয়। ‘হামনি-কে আদমি’ বলে ভোট নিয়ে যাওয়ার দিন শেষ। শ্রমিকরা এখন কাজ চায়। ব্রহ্মানন্দবাবুর কথায়, কংগ্রেস এতদিন মনে করত, বাগান তাদের ‘ভোটব্যাঙ্ক’। শ্রমিকরা এ বার তাকে ভুল বলে প্রমাণ করে দিয়েছে।

Advertisement

তাই বলে ইউনিয়নের নেতৃত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই বলেই তাঁদের দাবি। দু’জনেই বলেন, ‘‘ভোটে হারলেও অজিত সিংহই সাধারণ সম্পাদক, কংগ্রেস বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালা তাঁদের মতোই সহকারী সাধারণ সম্পাদক। কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি টিকিটে নির্বাচিত হলেও কৃপানাথ মালা এখনও তাদের আরেক সহকারী সম্পাদক, জানান সনাতন মিশ্র ও ব্রহ্মানন্দ কুর্মি। তাঁদের কথায়, ‘‘দশ বছর আগের মনোবৃত্তি আজ আর নেই। শ্রমিকরা এখন চিন্তাভাবনা করে ভোট দেন।’’ পরক্ষণেই তাঁদের দাবি, ভোটের ফলাফলে ইউনিয়নের শক্তি বিন্দুমাত্র কমেনি। যাঁকেই ভোট দিন না কেন, শ্রমিকরা তাঁদের ইউনিয়নের প্রতি আস্থাশীল।

সনাতন মিশ্র বলেন, যে রাজনৈতিক দল শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়, তাঁরা তাদেরই সঙ্গে রয়েছেন। এতদিন কংগ্রেস তাদের সঙ্গে রয়েছে বলে মনে হয়েছে, তাই কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে। এরচেয়ে বড় কথা, এই অঞ্চলে চা বাগানের গোড়াপত্তনের সময় একটিই রাজনৈতিক দল ছিল। সেটি হল কংগ্রেস। শ্রমিকরা কংগ্রেস নেতাদেরই সরকার বলে মনে করতেন। এখন দিন বদলেছে। ব্রহ্মানন্দ কুর্মি যোগ করেন, ‘‘সে সময় বাগানগুলিতে রেডিও-ও ছিল না। আজ শ্রমিকরা নিয়মিত টিভি দেখেন। হাতে হাতে মোবাইল। পৃথিবীর সমস্ত খবর জানতে পারেন তাঁরা।’’

লোকসভা ভোটের সময় থেকেই ইউনিয়ন নেতাদের নজরে পড়ে, বাগান শ্রমিকদের মতিগতিতে পরিবর্তন ঘটছে। নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ শোনার জন্য পাগল হয়ে উঠছিলেন তাঁরা। নইলে উধারবন্দের বিজেপি প্রার্থী মিহিরকান্তি সোমকে জেতাতেন না। মিহিরবাবু ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অজিত সিংহের তুলনায় শ্রমিকদের কাছে বলতে গেলে অচেনা মুখ। কিন্তু কাশীপুরের মত বাগানে কংগ্রেস পেয়েছে ৪০০ ভোট। বিজেপি ১১০০। আসলে প্রার্থীকে নয়, শ্রমিকরা ভোট দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীকে। ধলাই আসনেও শ্রমিকরা মোদীর প্রার্থী পরিমল শুক্লবৈদ্যকে জিতিয়ে দিয়েছেন বলে জানান তাঁরা। এমন মোদী হাওয়াতেও লক্ষ্মীপুরে রাজদীপ গোয়ালার জয়কে তাঁরা ‘কাজের সাফল্য’ বলে উল্লেখ করেন। দুই নেতাই একযোগে বলেন, ‘‘উপনির্বাচনে জিতে মাত্র ১৫-১৬ মাস কাজের সুযোগ মিলেছিল। প্রতিটি দিন তিনি কাজে লাগিয়েছেন।’’

তাহলে অজিতবাবু কেন পারলেন না? তুলনা টানার প্রশ্নে অস্বস্তিতে পড়েন ইউনিয়নের পোড়খাওয়া দুই নেতা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘অজিত সিংহ নিশ্চয়ই ভুল করেছিলেন। তার খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। তিনি কয়েকজন মানুষকে বেশি ভরসা করেছিলেন। এই বারের ভোটে জেতার জন্য আরও ভাল মানুষের পরামর্শ নেওয়া তাঁর উচিত ছিল।’’ রাস্তাঘাট নিয়ে গণরোষও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে করেন দু’জনেই।

তবে বিজেপি জেতার পরই কিছু সংগঠন, বিশেষ করে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ বাগান শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন বলে অভিযোগ জানান তাঁরা। সনাতনবাবু বলেন, ‘‘এরা এমনভাবে প্রচারে মেতেছে, যেন আমরা ভোটের ময়দানে কাজ করেছি।’’ বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়ন যে মোটেও কংগ্রেসি সংগঠন নয়, তা বোঝাতে তাঁরা বারবার টেনে আনেন রাতাবাড়ির বিজেপি বিধায়ক কৃপানাথ মালার কথা। উল্লেখ করেন জগন্নাথ সিংহ ও গৌরীশঙ্কর রায়ের কথা। বলেন, ‘‘ওঁরা দল বদলালেও ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রভাব পড়েনি। এ ছাড়া, বিশ্বনাথ উপাধ্যায় অন্য দলের নেতা ছিলেন। তাতে সমস্যা হয়নি।’’ তাই ইতিহাস ও আইন-কানুন জেনে ট্রেড ইউনিয়ন করতে বিপক্ষদের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

তবে পরামর্শ তাঁরা যাই দিন না কেন, রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এবং চা-বাগানগুলিতে কংগ্রেস প্রার্থীদের শোচনীয় হারের পর ইউনিয়ন নেতারা স্বভাবতই চিন্তিত। চিন্তিত, কারণ বিএমএস এ বার স্বাভাবিক ভাবেই ইউনিয়নের নেতৃত্ব দখলের কিংবা ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে। চেষ্টা করবে বরাক চা-শ্রমিক ইউনিয়নকে ‘অ-কেজো’ করে দিতে। সে কাজে প্রাথমিক ভাবে বিএমএস খানিকটা সফল। কারণ শ্রমিকদের ভিড়টাকেই তাঁরা ইউনিয়ন অফিস থেকে দূরে রাখতে পেরেছে। সে কারণেই চিন্তা ইউনিয়ন নেতাদের রয়েছেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement