প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য শহরে মাঝেমধ্যেই যানজট হচ্ছে। সঙ্গে শব্দদৈত্যের তাণ্ডব। বারোয়ারি পূজার চেয়ে বাড়িঘরের প্রতিমা বিসর্জনই এখন বেশি ভোগায়। মনসা পূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা—সবেতেই প্রতিমা নিয়ে পরিক্রমা চলে। ফল ভুগতে হয় অন্যদের।
এ নিয়ে শহরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আজ ক্ষোভ ব্যক্ত করে। শিলচরের মধ্যশহরে নাগরিক সভায় তাঁরা জানিয়ে দেন, এ সব চলতে পারে না। জেলা প্রশাসনকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যে প্রতিমা নিরঞ্জনের দাবি জানানো হয়। তবে তা থেকে বাদ দেওয়া হয় দুর্গাপূজার দশমীকে। সাধারণ মানুষের দাবি, বাড়িঘরের পুজোর বিসর্জনের জন্যও প্রশাসনের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হোক। মাইক ব্যবহারে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে কড়া ভূমিকা গ্রহণের আর্জি জানানো হয়। বিজেপি নেতা তথা পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর প্রতিমা নিরঞ্জনে নাগরিক যন্ত্রণায় ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘‘অধিকাংশ প্রতিমা বিসর্জন করা হয় না। শহর ঘুরিয়ে বিসর্জন ঘাটে নিয়ে নদীর পারে রেখে দেওয়া হয়। পরে ওই সব মূর্তির হাত-পা খসে পড়ে। চোখ-মুখ সরে গিয়ে বিকৃত রূপ নেয়।’’ শহর পরিক্রমার নামে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে বেলেল্লাপনা চলে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ক্ষোভ দানা বাঁধছিল কিছুদিন ধরেই। দুর্গাপূজা নিয়ে জেলা প্রশাসনের ডাকা বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠেছিল। পুলিশ সুপার রজবীর সিংহ সে দিন জানিয়ে দেন, নাগরিক সচেতনতা ছাড়া প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ন্ত্রণ আনা মুশকিল।
তাঁর কথার সূত্র ধরেই আজ শিলচরের মধ্যশহরে নাগরিক সভার আয়োজন করে নেতাজি ছাত্র যুব সংস্থা। শুরুতেই সভার আহ্বায়ক অভিজিৎ ভট্টাচার্য দু’টি ঘটনার উল্লেখ করেন। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীকে পরিজনেরা ইটখলার হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় এমন যানজট হয় যে, অ্যাম্বুল্যান্স এগোতে পারছিল না। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই পথ ছেড়ে রোগীকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাবেন। ভিড়ের মধ্যে গাড়ি ঘোরানোও সহজ কাজ নয়। তবু তাই করা হল। কিন্তু মেডিক্যালের রাস্তাতেও ওই একই যন্ত্রণা। শেষ পর্যন্ত দুই-আড়াই ঘণ্টায় মেডিক্যালে পৌঁছনো হল বটে। কিন্তু ডাক্তার দেখেই বলে দিলেন, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনাটিও একই ধরনের। প্রথমটি ছিল মনসাপূজার, দ্বিতীয়টি গণেশপূজার।
এগুলি যে বিধিসম্মতও নয়, নানা উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন তিন শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত। পুরোহিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সচিব কিশোর ভট্টাচার্য জানান, তিনি তাঁর কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কীত সমস্ত পুরোহিতদের বলবেন, পুজোর আগেই বিসর্জন কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে গৃহকর্তাদের যেন তাঁরা বলেন। লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্য জানান, মাটির প্রতিমায় পূজা হলে তার বিসর্জন আবশ্যিক। যেখানে-সেখানে পূজিত দেব-দেবীকে রেখে দিলে সেই পূজায় পুণ্য হয় না, বরং অমঙ্গলই হয়। অমরেন্দ্র ভট্টাচার্যের কথায়,‘‘ মা-বাবার মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যে ভাবে সৎকার করা হয়, বিসর্জনের তত্ত্বটাও অনেকটা তাই। বিসর্জনে আগে গাওয়া হতো বিরহ-বিধুর গান। এখন চলে উদ্দাম নৃত্য।’’ তিনিও রাস্তাঘাটে প্রতিমা ফেলে রাখাকে অবমাননা বলে উল্লেখ করেন। কবি-সাহিত্যিক অতীন দাশ, সদরঘাট শনিমন্দির পরিচালন সমিতির সম্পাদক রমাকান্ত দেব, নাগরিক স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিদাস দত্ত, শিলচর বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনস কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মিত্র, সুব্রত রায়, সুজয়া ভট্টাচার্য, তুহিনা শর্মাও যখন-তখন শহরে মূর্তি নিয়ে বিসর্জনের জন্য বেরিয়ে পড়ার বিরোধিতা করেন। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত দীপক সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘সুশীল সমাজ আপত্তি করতে পারে, কিন্তু সেসব কার্যকর করতে হবে প্রশাসনকে।’’ পুরপ্রধান নীহারবাবুও জানান, পুরসভার আসলে কার্যকরী ক্ষমতা নেই। এই সব নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ দরকার। এর পরই দিনতারিখ চূড়ান্ত না হলেও শীঘ্র জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকপত্র প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। তাঁরা আশাবাদী, বিসর্জনের নামে নাগরিক যন্ত্রণার এমন বিরোধিতার পর এ নিয়ে প্রশাসনের কঠোর হতে আর কোনও বাধা থাকবে না।