পর্দায় তিনি দুর্বলের রক্ষাকর্তা, অপরাধীর যম। অন্যায় সহ্য করা তাঁর ধাতে নেই।
বাস্তবে তাঁরই পিছু ছাড়ে না বিতর্ক। কখনও কৃষ্ণসার হরিণ মেরে জেলে যান, কখনও ফুটপাথবাসীকে গাড়িচাপা দেন, কখনও নিজেরই প্রেমিকাকে নির্যাতন করেন, কখনও সতীর্থ নায়কের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর বেশির ভাগ সময়েই শোনা যায়, অ্যালকোহলের প্রভাবেই নাকি এমন আচরণ।
এই স্ব-বিরোধিতার নামই সলমন।
বুধবার তাঁর পাঁচ বছরের সাজা ঘোষণার পর কলকাতার এক ফিল্ম উৎসাহী মন্তব্যটা ছুড়ে দিলেন, ‘‘সাব-ইনস্পেক্টর চুলবুল পাণ্ডেকেই কি না পুলিশ টানতে টানতে জেলে নিয়ে যাবে!’’ হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সে দৃশ্য দেখা যায়নি। তবে চর্চাটা চলছিল। সলমনের শেষ কয়েক বছরের ফিল্ম-ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ‘দবঙ্গ’-এর চুলবুলকে বাদ দিলেও ‘গর্ব’ ও ‘ওয়ান্টেড’ ছবিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ-বেশেই পর্দা কাঁপিয়েছিলেন সল্লুভাই। ‘এক থা টাইগার’-এ তিনি আবার দুঁদে গুপ্তচর।
বাস্তবে পুলিশ, এফআইআর, আদালত— শব্দগুলো কিন্তু ধাওয়া করে বেড়ায় তাঁকেই। ১৯৯৮ সালে ‘হম সাথ সাথ হ্যায়’-এর শ্যুটিং করতে গিয়েছিলেন রাজস্থানে। সইফ, তব্বু, নীলম, সোনালিদের সঙ্গে শিকার করে বসলেন কৃষ্ণসার হরিণ। বিচারাধীন হিসেবেই যেতে হল জেলে। পরে অবশ্য জামিনও পেলেন। তার পর নিজের শহর মুম্বইয়েই মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে ফুটপাথবাসীদের চাপা দেওয়ার অভিযোগ।
অথচ দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এই সলমনই নিজে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়েছেন। ছবি এঁকে টাকা তুলেছেন। অকাতরে সাহায্য করেছেন বহু মানুষকে। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও জরিমানার টাকা দিতে না পেরে যে সব বন্দি জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না, তাঁদের হয়ে টাকা দিতে চেয়েছেন। আবার তাঁরই বিরুদ্ধে গত মাসেও এফআইআর হয়েছে যে, বিমানে ওঠার সময়ে এক সমাজকর্মীকে হেনস্থা করেছেন তিনি। বাড়ির উল্টো দিকের বাসিন্দা এক ধীবর পরিবার অভিযোগ করেছিল, সলমনের দেহরক্ষীদের চাপে তারা সমুদ্রতীরে নৌকোটা পর্যন্ত রাখতে পারছে না। কেন? সলমনের সমুদ্র-দর্শনে নাকি ব্যাঘাত হচ্ছে!
এ সব তো না-হয় অভিযোগ! প্রমাণের অপেক্ষা। কিন্তু প্রকাশ্যেও তিনি যে মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারান, তার অঢেল দৃষ্টান্ত রয়েছে। কখনও চিত্রসাংবাদিককে ধাক্কা মেরেছেন। কখনও প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে প্রশ্ন শুনে মাথা গরম করেছেন। আবার তাঁরই এক ভক্তের গায়ে হাত তোলার ‘অপরাধে’ নিজের দেহরক্ষীকেই বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষিয়েছেন। এই সর্বশেষ ঘটনাটির উদাহরণ দিয়েই সলমনের কোনও কোনও ভক্ত সগর্বে বলে থাকেন, ‘‘বলিউডের অন্য কোনও ‘খান’ নিজের ভক্তের অপমান এতটা গায়ে মাখবেন না।’’
তিরটা মূলত যাঁর দিকে, সেই শাহরুখের সঙ্গেও এক পার্টিতে তাঁর প্রায় হাতাহাতি বেধেছিল। বরফ খানিকটা গলেছে এই সে দিন। সলমনের বোন অর্পিতার ডাকে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে আসেন শাহরুখ। দুরন্ত ফ্রেম পেয়ে যায় তামাম মিডিয়া— অর্পিতার মাথায় একই সঙ্গে চুমু এঁকে দিচ্ছেন শাহরুখ-সলমন। মঙ্গলবার রাতেও সলমনের বাড়ি গিয়েছিলেন শাহরুখ।
গিয়েছিলেন সঙ্গীতা বিজলানিও। মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ঘরণী হওয়ার বহু আগে যাঁর সঙ্গে সলমনের বিয়ের কার্ডটা পর্যন্ত নাকি ছাপা হয়ে গিয়েছিল। এখানেও পর্দার সঙ্গে অদ্ভুত অমিল। ‘প্যার’ করলেন একের পর এক, কিন্তু ‘শাদি’ দূর অস্ত্। ‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’ বা ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’-এর নায়ক আজও অবিবাহিত। সঙ্গীতার পর জীবনে আসেন ঐশ্বর্যা রাই। ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর মতো দুরন্ত হিট দেওয়ার পরে সেই সম্পর্কেও নামল অন্ধকার। শোনা গেল, ‘কুছ না কহো’ ছবির সেটে নাকি ঐশ্বর্যাকে মেরেই বসেছেন সলমন। মাঝরাতে মদ্যপ অবস্থায় নাকি হাজির হয়েছেন তাঁর বাড়িতে। অভিনেতা বিবেক ওবেরয় অভিযোগ তুললেন, ঐশ্বর্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুরু হওয়া ইস্তক সলমন তাঁকে ফোন করে খুনের হুমকি দিচ্ছেন।
এর পর ক্যাটরিনা কাইফ। প্রেমিক সলমন সযত্নে আগলে বলিউডের অ-আ-ক-খ হাতে ধরে শেখালেন তাঁকে। অথচ সেই প্রেমিকই নাকি এক দিন রাগের মাথায় ক্যাটরিনার জিনিসপত্র তাঁর ফ্ল্যাট থেকে ছুড়ে ফেলে দেন। নাটকের পরবর্তী অঙ্ক অচিরেই দেখা গেল। ক্যাটরিনা বর্তমানে রণবীর কপূরের প্রেমিকা। সলমন নিজে কোনও সম্পর্ক নিয়েই বিশেষ মুখ খোলেননি। অতি সম্প্রতি এক টিভি শোয়ে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘‘আমি তো একটা সম্পর্কে থাকতেই চাই। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুতেই যেন হয়ে উঠছে না!’’
কেন এই একমাত্র অপূর্ণতা? সেটাই বলা যেতে পারে রহস্য। কারণ, সলমনের গুণগ্রাহীরা মনে করেন, একটা ব্যাপারে পর্দা আর রক্তমাংসের মানুষটার কোনও ফারাক নেই। সেটা হল— ‘সোনার হৃদয়’। মুম্বইয়ের এক বিনোদন সংস্থার কর্ণধার বলছিলেন, ‘‘লোকটাকে সবাই ভালবাসে কেন জানেন? ও মানুষটা ভীষণ ভাল। নিঃশর্তে সাহায্য করে। ধরুন, এসি সারাতে বাড়িতে মেকানিক এল। তাকে নিয়ে বসে যাবে আড্ডায়। বলবে— সন্ধেবেলায় চলে আসিস।’’ কাশ্মীরের গুলমার্গবাসী এক গাড়িচালক বলছিলেন, ‘‘সলমন শ্যুটিং করতে এসে আমাদের মধ্যে মিশে গেলেন। আর শাহরুখের ‘জব তক হ্যায় জান’-এর শ্যুটিং স্পটে দু’কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।’’
তা হলে এত বিতর্ক কেন? বিনোদন সংস্থার কর্তাটি বলছিলেন, ‘‘ছেলেমানুষি। মাতাল হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। বলতে পারেন, মাথার পোকা নড়ে ওঠে।’’ তাই মুন্নি নয়, চুলবুলই বদনাম হন বারবার।