মহারাষ্ট্রের সাতারায় শিবসেনার বিক্ষোভ। রবিবার । ছবি: পিটিআই।
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারার দায়ে জেলে যেতে বসেছিলেন। মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। তবে আপাতত ‘বজরঙ্গি ভাইজানে’র বক্স অফিস তাঁর ভাবমূর্তি অনেকটা চাঙ্গা করে দিয়েছিল। কিন্তু সলমন খান ফের প্রমাণ করলেন, বিতর্ক এড়িয়ে বাঁচতে জানেন না তিনি। শনিবার মধ্যরাতে তাই ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণ মামলায় ফাঁসির আসামি ইয়াকুব মেমনের সমর্থনে পাঁচ-পাঁচটা টুইট করে বসলেন!
আগামী ৩০ জুলাই ফাঁসি হওয়ার কথা ইয়াকুবের। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সলমন কিন্তু তাঁর দবঙ্গ স্টাইলে গড়গড় করে লিখলেন, ‘‘কোনও নির্দোষকে হত্যা করা মানে মনুষ্যত্বকেই হত্যা করা!’’ এমনিতে সলমন ইদানীং ‘বিয়িং হিউম্যান’ নামে একটি সংস্থা চালান। বজরঙ্গি ছবিতেও তাঁর পরিচিত ঢিসুম-ঢাসুম ছেড়ে তিনি বেশ ‘মানবিক’ মুখ দেখিয়েছেন। এ বার টুইটারে নবাগত ভাইজান সোশ্যাল মিডিয়াতে মানবিকতার ফুলঝুরি ছোটাতে গিয়ে নতুন করে বিপদ ডেকে আনলেন। একেবারে পাক প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলে বসলেন, ‘‘শরিফ সাব, আপনার কাছে অনুরোধ, সে (টাইগার) আপনার মুলুকে থাকলে দয়া করে আমাদের জানান। কিধর ছুপা হ্যায় টাইগার?’’ লিখলেন, ‘‘টাইগারেরই তো অভাব ভারতে। টাইগার কো লাও!’’
ফল? ক’দিন আগেই গাড়ি চাপা মামলার রায় বেরনোর দিন, যে সলমনের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বান্দ্রার গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ভিড় জমিয়েছিল জনতা, রবিবার দিনভর সেই বাড়ির সামনেই বিক্ষোভের ঢল। ছবির পোস্টারে কালি। সলমনের প্রিয় বলিউডও চুপ। দেশ জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে ছিছিক্কার। শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হল সলমনকে। বাবার বকুনি খেয়ে মুছে ফেললেন পুরনো টুইট। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সলমনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি এবং শিবসেনা সমর্থকরা। তাদের অভিযোগ, সলমন দেশদ্রোহী মন্তব্য করেছেন। একই বক্তব্য রামদেবেরও।
সরাসরি দেশদ্রোহের কথা যাঁরা বলেননি, তাঁরা আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ তুলেছেন। বিজেপি মুখপাত্র সাইনা এনসির কথায়, ‘‘দেশের শীর্ষ আদালত প্রমাণ দেখেই ইয়াকুবকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আমরা কেউই তার বিরোধিতা করতে পারি না।’’ কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের কথায়, ‘‘আমি জানি না, ইয়াকুব মেমন আত্মসমর্পণ করেছে, নাকি তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ওকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, এটাই যথেষ্ট।’’ শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের কথায়, ‘‘কত লোকে কত কথা বলে। সলমন কি আদালতের রায়কে প্রশ্ন করছেন?’’ ব্যতিক্রম একমাত্র বিজেপি সাংসদ অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। তিনি বলছেন, ‘‘সলমনকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। ইয়াকুব ইতিমধ্যেই ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে। কারও ক্ষমাপ্রার্থনাকে সমর্থন করার মধ্যে কোনও ভুল আছে বলে মনে করি না।’’
টাডা আদালতের বিচারপতি পি ডি কোডে, যিনি ইয়াকুবকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছেন, তিনিও বলছেন, সলমনের টুইট তাঁর ব্যক্তিগত মত। বাক্স্বাধীনতা সকলেরই আছে। সেই বক্তব্য কতটা প্রাসঙ্গিক সেটাই প্রশ্ন। আবার মুম্বই বিস্ফোরণ মামলার বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি উজ্জ্বল নিকমের দাবি, ‘‘সলমনের টুইট আপত্তিজনক। দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তিনি।’’ উজ্জ্বলের প্রশ্ন, সলমন জানলেন কী করে টাইগারই আসল দোষী? উনি কি এই ষড়ষন্ত্রের কথা জানতেন? ইয়াকুবকে কি উনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই নির্দোষ বলছেন?
বিপদ আঁচ করে এ দিন সকালেই অবশ্য বিবৃতি দিয়েছিলেন সলমনের বাবা সেলিম খান। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ছেলের মন্তব্য সমর্থন করি না। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু না জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়। ওর এ সব বলার দরকার ছিল না।’’ সেলিমের চাপেই আজ বিকেল পাঁচটায় ফের পরপর টুইট করেন সলমন। প্রথমে লেখেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, টাইগার মেমনের দোষের জন্য তার ফাঁসি হওয়া উচিত। এখনও তাই মনে করি। আরও বলেছিলাম, ইয়াকুবকে যেন টাইগারের জন্য ফাঁসি দেওয়া না হয়।’’ পরের টুইটে লেখেন, ‘‘ইয়াকুব নির্দোষ, তা বলিনি। বলতে চাইওনি। দেশের বিচারব্যবস্থার উপর আমার ভরসা আছে।’’ তৃতীয় টুইটে দাবি, ‘‘মুম্বই বিস্ফোরণে অনেক মানুষ নিহত হন। আমি বারবার বলেছি, কোনও নির্দোষের মৃত্যু আসলে মনুষ্যত্বের মৃত্যু।’’ তার পর গত রাতের টুইটগুলি মুছে ফেলে সলমন লেখেন, ‘‘বাবা ফোন করে আমায় মন্তব্য ফিরিয়ে নিতে বলেছেন। এগুলো ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। মন্তব্য ফিরিয়ে নিলাম।’’ তার পর নিঃশর্তে ক্ষমা চেয়ে নেন তারকা।
বৃহস্পতিবার ইয়াকুবের ফাঁসির দিন ধার্য রয়েছে। সলমন যে ভাবে তাঁকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন, তা না বললেও আজ কিন্তু ৩০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ফের ইয়াকুবের ফাঁসি মকুবের আর্জি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এর মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের মণিশঙ্কর আইয়ার, সিপিএমের প্রকাশ ও বৃন্দা কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, ডিএমকে-র তিরুচি শিবা, আইনজীবী রাম জেঠমলানী, কে টি এস তুলসি, অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ, পরিচালক মহেশ ভট্ট, সমাজকর্মী অরুণা রায়, জঁ দ্রেজ প্রমুখ।
মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের কাছে একই আবেদন করেছেন ইয়াকুবের স্ত্রী রহিনও। আইনজীবী কে টি এস তুলসির মতে, ‘‘ইয়াকুব ভারতকে যা সাহায্য করেছে, তাতে ওর প্রতি এ দেশের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’’ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মতে, ‘‘আমরা বলছি শাস্তি হোক, কিন্তু আমরা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে।’’