উচ্চ মাধ্যমিক, বিএসসি দুইই গুরুচরণ কলেজে পড়েছি। এমএসসি করি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি। তা সত্ত্বেও হরকিশোর হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।
প্রত্যেকেরই নিজের প্রাথমিক ও বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের প্রতি একটা পৃথক আকর্ষণ থাকে। আমার ক্ষেত্রে তা আরেকটু বেশি। এর একটি ভিন্ন কারণ রয়েছে। আমি ত্রিপুরার এক স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েছি। সে স্কুলের কথা কিছুই আমার মনে নেই। পরে আমরা হাইলাকান্দিতে চলে আসি। বাবা তামা-কাঁসা বিক্রি করতেন। ওই আয়ে ছয় সন্তানকে নিয়ে সংসার টানা যাচ্ছিল না। দাদা তখন টেলারিং-এর কাজ শুরু করলেন। আমিও পড়া ছেড়ে তাঁকে সাহায্য করতে লেগে যাই। বছর পাঁচেক পর আর্থিক অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলে স্কুলে ভর্তি হতে চাই। কিন্তু সমবয়সীরা তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আমি কি আবারও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করব! ওই বয়সে কেউ কি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি নেবে! তবে কি সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু করব! কিন্তু দ্বিতীয় বা সপ্তম, হাইলাকান্দির কোনও স্কুল আমাকে নিতে রাজি হল না।
সে সময় এসএস কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন এস সি পাল। সম্পর্কে আমার দাদা। তাঁকে বলতেই তিনি নিজে হরকিশোর স্কুলে যোগাযোগ করেন। ১৯৫৮ সালে সোজা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। স্কুলটিও নতুন। ১৯৫৬ সালে এর শুরু। বিজয়কুমার ধর বিজ্ঞান পড়াতেন। অঙ্ক প্রমথ পাল। ইংরেজি পড়াতেন প্রমোদ সেনগুপ্ত। জমিরউদ্দিন স্যার ইতিহাস পড়াতেন। পরে আসেন হৃষিকেশ বিশ্বাস (ইংরেজি), মাখললাল পালচৌধুরী (অঙ্ক)। প্রথম প্রধানশিক্ষক ছিলেন কামিনীকুমার দত্ত। জ্যামিতি পড়াতেন। তাঁর বই, ‘জ্যামিতি প্রবেশিকা’ স্কুলে স্কুলে পাঠ্য ছিল। খুব কড়া প্রশাসক ছিলেন। সকাল ১০টা বাজতেই গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। ফলে শিক্ষক-ছাত্র সবাইকে ১০টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতেই হতো। তখন ১০টাতেই স্কুলে ঢোকার নিয়ম ছিল। আমি এই স্কুলে পড়াকালীনই কামিনীস্যার অবসর নেন। পরবর্তী প্রধানশিক্ষক ছিলেন মাখললাল পালচৌধুরী।
মনে পড়ে সতীশচন্দ্র কাব্যতীর্থ স্যারের কথা। সংস্কৃত পড়াতেন। আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। পরিবারের অবস্থা ভাল নয় জেনে প্রায়ই ছুটির পর বলতেন, এক সঙ্গে যাব। তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে আমাকে শবরি কলা খেতে দিতেন। আজও শিক্ষক-ছাত্রের সেই সম্পর্ক টিকে আছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম আমার শিক্ষা-মন্দির হরকিশোর স্কুলে। হীরক জয়ন্তী পালিত হল। দেখে ভাল লাগল, বড় বড় দালানবাড়ি হয়েছে এখন। আমরা বাঁশ-বেতের ঘরে পড়েছি। দু’টি মাত্র ঘর। তাও দরজা-জানালা নেই। চারদিকে ধানের খেত। তবু প্রশ্ন জাগে, মাখললাল পালচৌধুরী, প্রমথ পাল-দের মতো স্যাররা কি এখনও আছেন? কী সন্তানসম ভালবাসা ছিল তাঁদের! স্কুলে গিয়েই দেখতাম, ক্লাশের ভিতরে গোবরের স্তূপ। আমাদের প্রথম কাজ হতো সে সব সাফাই করা। শিক্ষকরাও সেই কাজে হাত লাগাতেন। ফুটবল খেলতাম বাতাবি লেবু দিয়ে।
এই স্কুল এখন সরকারি অনুদানপুষ্ট হলেও শুরু হয় হরকিশোর রায়সাহেবের একান্ত ইচ্ছায়। তিনিই হাইলাকান্দির লক্ষ্মীশহরে ২২ বিঘা জমি দান করেন, শিক্ষক নিয়োগ করেন। পরে রায়সাহেবের ছেলে হিমাংশু চক্রবর্তী ছাত্রাবাসেরও ব্যবস্থা করেন। দূরের ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কত বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে মনে ভিড় করে! তখন বিদ্যালয় পরিদর্শকরা স্কুলগুলিতে নিয়মিত যেতেন। আমি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বিদ্যালয় পরিদর্শক আমার ক্লাশে এলেন। ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ত্রিভুজ এঁকে ১৬ নং উপপাদ্য শেখানো হয়েছে কিনা, তার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। ছাত্রদের কেউ বোর্ডে যেতে সাহস করছিল না। প্রধানশিক্ষককে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। চোখেমুখে অস্বস্তির ছাপ। আমি তখন বোর্ডে গিয়ে প্রশ্নের জবাব দিই। পরিদর্শক আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
এখন আর বিদ্যালয় পরিদর্শকরা স্কুলে যান না। গেলেও ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেন না। যা কথা, তা শুধু প্রধানশিক্ষকের সঙ্গেই।
হরকিশোর স্কুলের সঙ্গে পৃথক আবেগের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, শেষ করব সেই আবেগের কথাতেই। আমি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হৃষিকেশ স্যার আমাদের স্কুলে যোগ দেন। ষান্মাষিক পরীক্ষার খাতা দেখে আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কুলে গিয়ে ভর্তি হতে। সম-মানের ছাত্রছাত্রী পেলে প্রতিযোগিতা মূলক মানসিকতা তৈরি হবে। পরে কথাটা শুনেই প্রধানশিক্ষক আপত্তি করলেন। খবর পেয়ে স্কুলে এলেন রায়বাহাদুরের পুত্র হিমাংশুবাবু। আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, পৃথক টিউশনের প্রয়োজন কিনা। বইখাতা, পোশাক-আশাকেরও খবর নিলেন। প্রধানশিক্ষক-সহ অন্য শিক্ষকদের বলে গেলেন, আমার প্রতি যেন বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়।
সে দিন স্কুলের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমি বলেছি, আজও বলছি, আমি রসায়নের অধ্যাপক। ফলে স্কুলের ল্যাবরেটরির কাজে আমাকে ডাকা হলে আমি সব ধরনের সাহায্যে প্রস্তুত। হরকিশোর স্কুল যে ভাবে আমার জীবন গড়ে দিয়েছে, সব কিছু দিয়েও সেই ঋণের একাংশ পূরণও সম্ভব নয়। তাই যোরহাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিলঙের সেন্ট এডমন্ডস কলেজ, শিলচরের গুরুচরণ কলেজ এবং সব শেষে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও অবসরপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ামক—এই সব পরিচিতিকে দূরে সরিয়ে আমার বলতে ভাল লাগে, আমি হরকিশোর হাইস্কুলের ছাত্র।