জম্মু ও কাশ্মীরের ডোডা জেলায় মঙ্গলবার গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ছবি: পিটিআই।
ফরিদাবাদ, হরিয়ানার একাধিক জায়গায় রবি এবং সোমবার চলেছিল তল্লাশি। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল বিস্ফোরক। সোমবার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে দিল্লির চাঁদনি চক। এই দুইয়ের মধ্যে যে একটা যোগসূত্র রয়েছে, তা নিয়ে এক প্রকার নিশ্চিত তদন্তকারীদের একাংশ। সেই জাল আরও কতটা বিস্তৃত, এখন তা-ই খুঁজে দেখতে চাইছেন গোয়েন্দারা। ইতিমধ্যে দিল্লি বিস্ফোরণের নেপথ্যে ‘ষড়যন্ত্রের’ তত্ত্বে সিলমোহর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জানিয়েছেন, কাউকে রেয়াত করা হবে না। মঙ্গলবারও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। ধৃত চিকিৎসক শাহিন শহিদের বাসভবনেও চলেছে অভিযান। বিস্ফোরণের আসল মাথা কে, সেটাই এখন খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের গোয়েন্দারা। বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২।
সোমবার দিল্লির অদূরে হরিয়ানার ফরিদাবাদে ৩৬০ কেজি আরডিএক্স তৈরির মশলা (অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট) উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ জানায়, উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে অভিযান চালিয়ে মোট ২৯০০ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যাতেই দিল্লিতে লালকেল্লার সামনে দাঁড়ানো গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। মৃত্যু হয় আট জনের। এই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা-ই এখন খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই এই ঘটনার তদন্তে নেমেছে এনআইএ-সহ একাধিক তদন্তকারী সংস্থা। চলছে ধরপাকড়। যে গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়েছিল, তার চালক উমর মহম্মদের মায়ের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হচ্ছে। বিস্ফোরণস্থল থেকে পাওয়া দেহাংশ শনাক্ত করতেই উমরের মায়ের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে বলে খবর।
দু’টি বিষয় তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে। এক, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার হওয়ার পরেই কি সন্দেহভাজনেরা সতর্ক হয়ে যান? তাই কি নানা জায়গায় লুকোনো বিস্ফোরক গাড়িতে তুলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল? দুই, ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই অবশিষ্ট বিস্ফোরক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নষ্ট করে ফেলেন তাঁরা। তদন্তকারীদের একটি সূত্র মনে করছে, ৯ এবং ১০ নভেম্বর রাতে ফরিদাবাদ, হরিয়ানায় যে অভিযান চলেছিল, তার জেরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন সন্দেহভাজনেরা। তাই দিল্লির লালকেল্লার কাছে ‘অপরিণত’ আইইডি ফাটিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সে কারণে তার প্রভাবও ছিল সীমাবদ্ধ। নয়তো আরও প্রাণহানি হতে পারত বলে আশঙ্কা তদন্তকারীদের একাংশের।
ফরিদাবাদ-যোগ
দিল্লি বিস্ফোরণে সম্ভাব্য ফরিদাবাদ-যোগ নিয়ে একটি ‘প্রমাণ’ মিলেছে বলে খবর। ‘দৈনিক ভাস্কর’-এর প্রতিবেদনে বিস্ফোরণস্থলের একটি ভিডিয়োর প্রসঙ্গ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, গাড়িতে বিস্ফোরণের পরেই কমলা রঙের আগুন দেখা গিয়েছে। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, সাধারণত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণ ঘটলে এই ধরনের আগুন দেখা যায়। কারণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জ্বলে যাওয়ার পর নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া নির্গত হয়। ঘটনাচক্রে, ফরিদাবাদ থেকেও উদ্ধার হয়েছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। যে গাড়িটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটির নম্বর প্লেট হরিয়ানার। সেই সূত্র ধরে জনৈক মহম্মদ সলমন নামে এক ব্যক্তিকে সোমবার রাতেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গাড়িটি তাঁরই নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে বলে দাবি পুলিশ সূত্রের। যদিও জানা যাচ্ছে, পুলিশি জেরায় সলমন জানিয়েছেন, তিনি গাড়িটি পুলওয়ামার এক বাসিন্দাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তবে গাড়ির নথিপত্রে এখনও নামবদল হয়নি।
কী ভাবে খোঁজ
কাশ্মীরে নাশকতার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি একটি বিশেষ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে তৈরি হত নাশকতার ছক। এমন খবর পাওয়ার পরেই তদন্তে নামে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। সেই তদন্তে নেমে ১৯ অক্টোবর শ্রীনগরে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার সাঁটার অভিযোগে চিকিৎসক আদিল আহমেদ র্যাদারকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। তাঁকে জেরা করে উঠে আসে নতুন তথ্য। আদিলকে জেরা করে আরও চিকিৎসকের হদিস পায় পুলিশ। তদন্তকারী সূত্রে খবর, কাশ্মীরে নাশকতার উদ্দেশ্যে যে বিশেষ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে, তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে তৈরি করত নাশকতার ছক। এ ছাড়া, ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এই চক্রের তদন্তে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। ধৃতেরা হলেন, আরিফ নিসর দার, ইয়াসির-উল-আসরফ, মকসুদ আহমেদ দার, ইরফান আহমেদ, জ়ামির আহমেদ। আদিলের সূত্র ধরে খোঁজ মেলে চিকিৎসক মুজ়াম্মিল আহমেদের।
চালকের মায়ের পরীক্ষা
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বিস্ফোরণের ঠিক আগে গাড়ির বর্তমান ‘মালিক’ তথা পুলওয়ামার চিকিৎসক উমর মহম্মদ গাড়িতে ছিলেন। সম্ভবত গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তিনিই। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বিস্ফোরণস্থল থেকে পাওয়া দেহাংশ শনাক্ত করার জন্য প্রথমে উমরের মায়ের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে। তার পর সেই ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে নিহতের সঙ্গে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, উমর ছিলেন পুলওয়ামার কোয়েল গ্রামের বাসিন্দা। উমরদের কোয়েল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা গুলাম নবি ভাটকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ধৃত সন্দেহভাজন
বিস্ফোরণের পরে দিল্লি জুড়ে অভিযান শুরু করে পুলিশ। আপাতত তিন দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে লালকেল্লাও। বিস্ফোরণের পর থেকে রাতভর দিল্লির পাহাড়গঞ্জ, দরিয়াগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকার হোটেলগুলিতে তল্লাশি চলেছে। খতিয়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন হোটেলের রেজিস্টার খাতা। দিল্লি পুলিশের সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, ওই অভিযানের সময়েই চার সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। যদিও তাঁদের নাম-পরিচয় এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
উত্তরপ্রদেশে অভিযান
মঙ্গলবার উত্তরপ্রদেশের লখনউ, সাহারানপুর, লখিমপুর খেরিতে তল্লাশি চালিয়েছেন তদন্তকারীরা। লখনউয়ের মুত্তাকিপুরে চিকিৎসক শহিদের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সন্ত্রাস দমন শাখা (এটিএস) এবং স্থানীয় পুলিশ। মহিলা চিকিৎসক শাহিনকে দিল্লি বিস্ফোরণের ঘটনায় যোগসাজশের অভিযোগে আগেই গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ, ফরিদাবাদে যে চিকিৎসক মুজাম্মিলের বাড়ি থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে যোগ রয়েছে শহিদের। রবিবার বনসকাঁথাতে গুজরাত এটিএসের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন মহম্মদ সুহেল। তাঁর লখিমপুরের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। ৭ নভেম্বর জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ গ্রেফতার করেছিল চিকিৎসক আদিল আহম্মেদকে। অনন্তনাগের বাসিন্দা আদিল সাহারানপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন বলে খবর। মঙ্গলবার সেখানেও তল্লাশি চালান তদন্তকারীরা।
রেয়াত নয়
মঙ্গলবার সকালে দু’দিনের সফরে ভুটানে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বসেই তিনি জানান, দেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলি এর শেষ দেখে ছাড়বে। যে যে এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে, তাদের একজনকেও রেয়াত করা হবে না। মোদী বলেন, ‘‘আজ আমি খুব ভারাক্রান্ত মনে এখানে এসেছি। কাল সন্ধ্যায় দিল্লির ভয়াবহ ঘটনা আমাদের সকলকে ব্যথিত করেছে। কাল সারা রাত ধরে আমি সমস্ত কেন্দ্রীয় এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যগুলি নিয়ে আলোচনা চলছিল। আমাদের তদন্ত সংস্থাগুলি এই ষড়যন্ত্রের শিকড় পর্যন্ত যাবে। যারা এই ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা হবে। একজনকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না।’’
শাহের নির্দেশ
মঙ্গলবার দফায় দফায় তদন্তকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেই বৈঠকে বিস্ফোরণের নেপথ্যে জড়িত প্রত্যেক দোষীকে খুঁজে বার করার নির্দেশ দেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছিলেন শাহ। সেই বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ মোহন, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অধিকর্তা তপন ডেকা, দিল্লির পুলিশ কমিশনার সতীশ গোলচা এবং এনআইএ-র ডিজি সদানন্দ বসন্ত। ভার্চুয়ালি বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশপ্রধান নলিন প্রভাত। সেই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পরে আবার একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তদন্তকারী সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা সেই বৈঠকে যোগ দেন। পরে বৈঠকের নির্যাস নিজেই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে জানান শাহ। সোমবার রাতে প্রথমে হাসপাতালে এবং পরে অকুস্থলে যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কথা বলেন পুলিশ আধিকারিক এবং তদন্তকারীদের সঙ্গে।
রাজনাথের বার্তা
কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানান, দিল্লির লালকেল্লার সামনে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত দোষীদের কাউকে রেয়াত করা হবে না। প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে দিল্লি ১০/১১-এর ঘটনা ‘মর্মান্তিক’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বিস্ফোরণে মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান রাজনাথ। তিনি বলেন, ‘‘আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দোষীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’’