Coromandel Express accident

ছড়িয়ে আছে দেহের স্তূপ, উপড়ে গিয়েছে রেললাইন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন

সিমেন্টের ভাঙাচোরা স্লিপার আর উল্টেপাল্টে যাওয়া কামরাগুলিকে পাশ কাটিয়ে কোনও রকমে পৌঁছলাম বাঁ দিকের নয়ানজুলির কাছে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের অন্তত ৭টা কামরা পড়ে রয়েছে সেখানে।

Advertisement

মৌসুমী খাঁড়া

বালেশ্বর শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ০৪:০৫
Share:

দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেস। —নিজস্ব চিত্র।

বাঞ্ছানিধি গার্লস স্কুলটা ছাড়িয়ে একটু এগোতেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে ইতিউতি আলো। তাতেই দেখতে পেলাম, সব কিছু কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। ট্রেনের কামরা একটার গায়ে আর একটা উঠে পড়েছে। কোনওটা উল্টে গিয়েছে। তাদের চাকাগুলো উপরের দিকে। কয়েকটা পাশের নয়ানজুলিতে পড়ে। মালগাড়ির উপরে উঠে পড়েছে আস্ত একটা ইঞ্জিন। যেন উড়ে গিয়ে ঘাড়ের উপর চড়ে বসেছে! রেলের লাইন বলতে কিছুই নেই। সিমেন্টের স্লিপারগুলি ভেঙেচুরে, লোহার রড বেরিয়ে একেবারে কঙ্কালসার। উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। ইতস্তত ছড়িয়ে মৃতদেহ। সাদা কাপড়ে ঢাকা। তার মধ্যেই ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। চিৎকার। আর্তনাদ। আর সব কিছু ছাপিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের আওয়াজ।

Advertisement

খড়্গপুর থেকে বেলদা, বালেশ্বর হয়ে যে রাস্তা সোজা গিয়েছে ভুবনেশ্বরে— সেই জাতীয় সড়কের উপরেই বাহানগা। জলেশ্বর পেরোনোর পর থেকেই বাড়ছিল যানজট। সেই জট কোনও রকমে কাটিয়ে যত এগোচ্ছিল গাড়ি, ততই বাড়ছিল পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ। একাধিক বার গাড়ি দাঁড় করাতে হল। সংবাদমাধ্যমের কর্মী পরিচয় দিয়েই এগোনো গিয়েছে। শেষে বাহানগা পৌঁছে জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডান দিকে ঢুকতেই পুলিশ আর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিল না। সেখান থেকে মেরেকেটে ৭০০ মিটার দূরেই সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। শুধু করমণ্ডল এক্সপ্রেস নয়, ঘটনাস্থলে পৌঁছে বোঝা গেল, একই সঙ্গে দু’টি ট্রেন আর একটা মালগাড়ি দুর্ঘটনার পড়ে একে অন্যের সঙ্গে জট পাকিয়ে গিয়েছে সেখানে। করমণ্ডল এক্সপ্রেস যাচ্ছিল শালিমার থেকে চেন্নাই। আর অন্য ট্রেনটি বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া যাচ্ছিল। তবে মালগাড়িটির গতিবিধি নিয়ে কারও কোনও ধারণাই নেই। কোথা থেকে এল, কোথায় যাচ্ছিল, কেউ কিছু জানেন না। তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ বললেন, এই মালগাড়িটিকেই পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ইঞ্জিন উঠে গিয়েছে মালগাড়ির উপর। বাকি ট্রেন বেলাইন হয়ে একাধিক কামরা পড়েছে পাশের ডাউন লাইনে। আর সেই লাইনে আসা হাওড়াগামী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ। সব মিলিয়ে এত বড় দুর্ঘটনা!

সিমেন্টের ভাঙাচোরা স্লিপার আর উল্টেপাল্টে যাওয়া কামরাগুলিকে পাশ কাটিয়ে কোনও রকমে পৌঁছলাম বাঁ দিকের নয়ানজুলির কাছে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের অন্তত ৭টা কামরা পড়ে রয়েছে সেখানে। ভিতর থেকে তখনও আসছে গোঙানির আওয়াজ। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী আটকে থাকা যাত্রীদের বাইরে বার করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয়েরাও হাত লাগিয়েছেন উদ্ধার কাজে। যাদের বার করে আনা হচ্ছে, সকলেই রক্তাক্ত। পাশ দিয়ে চাদরে মুড়িয়ে একটা মৃতদেহ নিয়ে গেলেন দু’জন। ওদের পিছন পিছন এগিয়ে গেলাম। একটা ম্যাটাডোরে সেই দেহ রাখা হল। এর পর এ দিক ও দিক থেকে তাতে তোলা হল একের পর এক দেহ। প্রায় তিরিশটা নিথর দেহ নিয়ে ম্যাটাডোরটা জাতীয় সড়কের দিকে এগিয়ে গেল এর পর। ম্যাটাডোরের ঝাঁকুনিতে ঢেকে রাখা চাদরগুলি একটু সরতেই নজরে এল, কোনও দেহই অক্ষত নয়!

Advertisement

রাস্তা থেকে আবার লাইনের ধারে ফিরছি, ছোট একটা জটলা দেখে দাঁড়ালাম। এঁরা সকলেই করমণ্ডল এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রি কারের কর্মী। অন্তত সাত জন সহকর্মীর কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না ওঁরা। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের শিমুলিয়া গ্রামের গৌরহরি মান্না বললেন, ‘‘সবে প্যান্ট্রি থেকে চা নিয়ে বেরিয়েছি। স্লিপার ক্লাসে যাব বিক্রি করতে। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। ছিটকে পড়লাম ফ্লোরেই। কী ভাবে, কী হল, কিছুই জানি না। আমার ভাগ্নে তার একটু আগেই এসি কোচে গিয়েছিল স্ন্যাক্স নিয়ে। এখনও ওকে পাইনি।’’ বলতে বলতে ডুকরে উঠলেন গৌরহরি।

এস ৪ কামরায় ছিলেন ক্যানিংয়ের প্রশান্ত মণ্ডল। যাচ্ছিলেন কোয়েম্বত্তূর। আচমকাই ট্রেনের একটা হুইস্‌ল শোনেন, আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা কামরাটা উল্টেপাল্টে যায়। তার পর প্রশান্ত দেখেন, তিনি কামরার নীচে পড়ে রয়েছেন। তার উপরে অন্যান্যেরা। চিৎকার। কান্নাকাটি। একই সঙ্গে বাইরে বেরোনোর প্রচণ্ড চেষ্টা। তখনও প্রশান্ত বুঝতে পারেননি কী হয়েছে! কিছু ক্ষণের চেষ্টার পর কোনও রকমে যখন বাইরে এলেন, বুঝতে পারলেন, তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। তাঁর আগের কামরা এস ৩ থেকে অনেকের দেহ উদ্ধার হয়েছে বলে জানালেন ওই যুবক। প্রশান্তের পায়ে ভাল মতো চোট লেগেছে। শরীরের আর কোথাও কিছু হয়নি। তাঁর ভাইপো কৃষ্ণপদও ওই ট্রেনে ছিলেন। তিনিও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। রেলের যে মেডিক্যাল টিম যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করছে, দু’জনেই কোনও রকমে গিয়েছেন সেখানে। চিকিৎসক দেখে বলেছেন, চোট তেমন গুরুতর নয়।

তবে প্রশান্ত-কৃষ্ণপদদের বাইরেও শয়ে শয়ে যাত্রী রয়ে গিয়েছেন। যাঁরা আটকে পড়েছেন কামরার ভিতরে। বেরোতে পারেননি শত চেষ্টাতেও। রাতেই ‘গ্যাস কাটার’ নিয়ে আসা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা কামরা কেটে আটকে থাকা যাত্রীদের উদ্ধার করছেন। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুল্যান্সে করে পাঠানো হচ্ছে হাসপাতালে। যদিও সেই উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অনেককে দেখেই মনে হচ্ছে, শরীরে আর প্রাণ নেই। নিথর। বহু যাত্রী এখনও পরিবার, পরিজনের খোঁজ করছেন। গোটা দুর্ঘটনাস্থল চষে ফেলেছেন। তবুও মেলেনি কোনও খবর। এরই মধ্যে কয়েক জন চুরি ছিনতাইয়ের অভিযোগ করছেন। কেউ মোবাইল খুঁজে পাচ্ছেন না তো কেউ আবার ব্যাগপত্র। এক জন মহিলা গলার হার ছিনতাই হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। তবে ঘটনাস্থলে থাকা এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘এই সময় কেউ এমনটা করবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়।’’

২০১০ সালের ২৮ মে পশ্চিম মেদিনীপুরের সরডিহা ও ক্ষেমাশুলির মাঝে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গভীর রাতে পৌঁছেছিলাম ঘটনাস্থলে। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৪৮ জন মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু শুক্রবার রাতে বাহানগায় এসে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, সে দিনের জ্ঞানেশ্বরীর চেয়েও শুক্রবারের করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার অভিঘাত আরও অনেক বেশি। যদিও এই দুর্ঘটনা ঠিক কী ভাবে হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

বাহানগাতেই বাড়ি জন্মেজয় সাহুর। ট্রেন দুর্ঘটনার সময় তিনি ওই লেভেল ক্রসিংয়ের কাছেই ছিলেন। মধ্যরাত অবধি উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন। তাঁর ফাঁকেই জানালেন, এক নম্বর লাইনে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। পিছন থেকে সেটিকে সজোরে ধাক্কা মারে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। তার পর সেটি গিয়ে পড়ে বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের উপর।

হয়তো কোনও শিশুর রেলসফরের সঙ্গী ছিল এই পুতুলটি। —নিজস্ব চিত্র।

ঘটনাস্থলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রী। চলন্ত ট্রেনের ভিতরে থেকে তাঁদের কেউই বুঝতে পারেননি, কোন ট্রেনের সঙ্গে কোন ট্রেনের ধাক্কা লেগেছে। আর রেল এখনও পর্যন্ত এই দুর্ঘটনার স্পষ্ট কোনও কারণ জানায়নি। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জন সংযোগ আধিকারিক আদিত্য চৌধরি জানিয়েছেন, আপাতত রেল উদ্ধার কাজকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

ভয়াবহ এক রাত কাটাচ্ছে বাহানগা। তার মধ্যেই রাত আড়াইটে নাগাদ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো প্রতিনিধি দল। যে দলে রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া এবং সাংসদ দোলা সেন। শুক্রবার রাতে টুইট করে মমতা বিশেষ দল পাঠানোর কথা বলেছিলেন। শনিবার সকাল ৮টা নাগাদ পৌঁছবেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তার আগে সারা রাত ধরে চলছে আটকে থাকাদের উদ্ধারের কাজ। চলছে আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর কাজ। তার মধ্যেই বেড়ে চলেছে মৃতের সংখ্যা। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কান্নার আওয়াজ।

এগিয়ে আর একটা কামরার দিকে যাচ্ছি, পায়ে কিছু একটা বাধল। আধো অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করলাম। তার পর মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে দেখলাম, একটা পুতুল। পরনে কোনও পোশাক নেই। উপুড় হয়ে পড়ে আছে ভাঙাচোরা লাইনের উপর। হয়তো কোনও শিশুর রেলসফরের সঙ্গী ছিল এই পুতুলটি। দুর্ঘটনার অভিঘাতে বিচ্ছেদ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন