গুজবের উপকরণগুলো ক্রমশ আকর্ষক হচ্ছে

এমন তো নয় যে, গুজব আগে রটত না। গুজব বরাবরই রটত। কিন্তু আগে গুজব ছড়াত মুখে মুখে বা লিফলেট, প্যামফ্লেটের মাধ্যমে। এমন অনেক বার হয়েছে যে, একটা জায়গায় যেখানে মহাত্মা গাঁধী কোনও দিনও যাননি, অথচ মুখে মুখে রটে গিয়েছে, ‘গাঁধী মহারাজ আসছেন, সকলে স্বাধীন হয়ে যাবে। অতএব তোমরা জেগে ওঠো।’

Advertisement

সুরঞ্জন দাস (ইতিহাসবিদ)

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:১১
Share:

সেই সময়: ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে কার্ফুর সময়ে বাগমারিতে।ফাইল চিত্র

যে কোনও অশান্তি-হাঙ্গামা বা দাঙ্গার ভয়াবহতা ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার জেরে বহু গুণে বেড়ে গিয়েছে। ফেসবুকের কারণে এখনকার দাঙ্গার একটা সংগঠিত চরিত্র তৈরি হয়েছে।

Advertisement

এমন তো নয় যে, গুজব আগে রটত না। গুজব বরাবরই রটত। কিন্তু আগে গুজব ছড়াত মুখে মুখে বা লিফলেট, প্যামফ্লেটের মাধ্যমে। এমন অনেক বার হয়েছে যে, একটা জায়গায় যেখানে মহাত্মা গাঁধী কোনও দিনও যাননি, অথচ মুখে মুখে রটে গিয়েছে, ‘গাঁধী মহারাজ আসছেন, সকলে স্বাধীন হয়ে যাবে। অতএব তোমরা জেগে ওঠো।’ আবার এমনও গুজব ছড়িয়েছে যে, তুমি যদি গাঁধী টুপি পরে থাক, তা হলে পুলিশ মারলে, গুলি করলেও তুমি মরবে না। তার পরে বাজারে-হাটে অনেক লিফলেট বিলি করা হত। হিন্দু বা মুসলিম সংগঠন, সকলেই এটা করত। সেগুলির বয়ান ছিল খুবই উস্কানিমূলক। ইউরোপে ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্টদের দাঙ্গার ক্ষেত্রেও গুজবের অসম্ভব ভূমিকা ছিল।

কিন্তু আগে যে গুজবটা ছড়াতে দশ দিন সময় লাগত, এখন সেটা এক মিনিটে ছড়াচ্ছে। সেই গুজবের সঙ্গে নানা ধরনের ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘সুপারইম্পোজ’ করে সেই সব ছবি এমন ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যে, তার প্রভাব বহু গুণে বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, গুজবের উপকরণগুলিকে পরিকল্পনামাফিক আকর্ষণীয় করে তোলা হচ্ছে। সংগঠিত ভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যেটা আগে ছিল না। গুজব ছড়ানোর পদ্ধতির এ ভাবেই পরিবর্তন হয়েছে।

Advertisement

গুজবের হাত ধরে দাঙ্গার চরিত্রও পাল্টেছে। যেমন ১৯৪০ সালের আগে বাংলায় যে দাঙ্গাগুলো হয়েছিল, তার একটা শ্রেণি-চরিত্র ছিল। কিন্তু তার সাংগঠনিক চরিত্র খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। শ্রেণি-চরিত্রের কারণ হল, অবিভক্ত বাংলায় বেশির ভাগ চাষিই ছিলেন মুসলমান। আর বেশির ভাগ জোতদারই ছিলেন হিন্দু। আবার যাঁরা ঋণ নিতেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম এবং মহাজনেরা ছিলেন হিন্দু। ফলে অনেক সময়েই একটা শ্রেণিগত দাঙ্গা হত, যা সাম্প্রদায়িক রূপ নিত। যেটার পিছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উস্কানি ছিল। কিন্তু সে সময়ের দাঙ্গাগুলোর সঙ্গে ‘ইনস্টিটিউশনাল পলিটিক্স’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি’র তেমন একটা যোগ ছিল না। সেগুলোর একটা ‘অটোনমি’ ছিল।

১৯৪৬-এর অশান্ত কলকাতা। ফাইল চিত্র

কিন্তু ১৯৪০ সালের পর থেকে দাঙ্গার সঙ্গে সাংগঠনিক রাজনীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির যোগাযোগ বেড়ে যায়। সেই সব দাঙ্গা অনেক সংগঠিত চরিত্র নেয়। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে যা তুঙ্গে পৌঁছয় ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গায় এবং পরবর্তীকালে নোয়াখালি, বিহার এবং পঞ্জাবের দাঙ্গার ক্ষেত্রে।

১৯৪৭ সালের পরে ভারতে যে ক’টা বড় দাঙ্গা হয়েছে, সে গুজরাত, গোধরা, ভাগলপুর বা গোরক্ষপুর যা-ই হোক, প্রতিটির কিন্তু এই একটা সাংগঠনিক চরিত্র রয়েছে, যার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সরাসরি যোগ রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পরে কলকাতায় বড় দুটো দাঙ্গা হয়েছে। একটি ১৯৬৪-’৬৫ সালে। আর একটি ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পরে। কলকাতার দাঙ্গাতেও সেই সংগঠিত চরিত্র ধরা পড়েছে একাধিক বার। তার মধ্যে ১৯৯২ সালে কলকাতায় যে দাঙ্গা হয়েছিল, সংগঠিত চরিত্রের পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক একটা চরিত্রও ছিল। এখন যত দিন যাচ্ছে, ততই দাঙ্গার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির যোগ শক্তিশালী হচ্ছে।

ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া সেই দাঙ্গার আশঙ্কা বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সতর্ক হতে হবে! এখনই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন