Souvik Maiti And Debojyoti Chakraborty

রক্তকণিকার বিকৃতি সারাতে আবার সেই ‘ফেলুদা’ জুটি

এ বার দিল্লির ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (আইজিআইবি)-এর সেই দুই বাঙালি সৌভিক মাইতি ও দেবজ্যোতি চক্রবর্তী ফের জুটি বেঁধেছেন দেশ থেকে সিকল সেল অ্যানিমিয়া দূর করার লক্ষ্যে।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:১০
Share:

(বাঁ দিকে) দেবজ্যোতি চক্রবর্তী এবং সৌভিক মাইতি (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া নির্মূলে পথ দেখাচ্ছেন দুই বঙ্গসন্তান।

করোনা কালে ঘরে বসে কোভিড পরীক্ষা করার জন্য এফএন-ক্যাস৯ এডিটর-লিঙ্কড ইউনিফর্ম ডিটেকশন অ্যাসে বা সংক্ষেপে ‘ফেলুদা’ টেস্ট কিট বানিয়েছিলেন এঁরাই। এ বার দিল্লির ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (আইজিআইবি)-এর সেই দুই বাঙালি সৌভিক মাইতি ও দেবজ্যোতি চক্রবর্তী ফের জুটি বেঁধেছেন দেশ থেকে সিকল সেল অ্যানিমিয়া দূর করার লক্ষ্যে। আক্রান্তদের রক্তে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে আগামী ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশ থেকে ওই রোগ নির্মূল করার যে উচ্চাকাক্ষী লক্ষ্য সরকার নিয়েছে, তা সফল করার অন্যতম কান্ডারি হলেন এই দু’জন।

বর্তমানে প্রথম ধাপে থাকা ওই গবেষণা যাতে সহজলভ্য এবং আর্থিক ভাবে সাশ্রয়ী হয়, তার জন্য আগামিকাল দেশের অন্যতম প্রতিষেধক নির্মাণ সংস্থা সিরামের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছে সিএসআইআর-আইজিআইবি। দাবি, আমেরিকায় যেখানে জিন প্রতিস্থাপন করে ওই রোগের চিকিৎসায় ব্যক্তি পিছু ২০ কোটি টাকা খরচ হয়, সেখানে এ দেশে তা হবে নামমাত্র খরচে। গবেষণার পরিধিকে বাড়াতে ও চিকিৎসাকে সহজলভ্য করতেই পুণের ওই সংস্থার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে কেন্দ্র। আগামিকাল প্রযুক্তি হস্তান্তরে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহের। এই প্রযুক্তি তৈরিরই মূল কারিগর হলেন সৌভিক ও দেবজ্যোতি। আমেরিকার পেটেন্টও পেয়েছেন তাঁরা।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া বংশানুক্রমিক ভাবে প্রাপ্ত রোগ। যাতে মানব শরীরের স্বাভাবিক গোলাকার লোহিত বা লাল রক্তকণিকাগুলির আকার পাল্টে গিয়ে কোষগুলি কাস্তে বা অর্ধচন্দ্রের আকার ধারণ করে। কোষের ওই বিকৃত আকারের জন্য দেহের সব অংশে অক্সিজেন সঠিক ভাবে পরিবহণ হয় না। যার ফলে আক্রান্তরা ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণজনিত সমস্যা, আলসারের মতো রোগে ভোগেন। আক্রান্তদের আয়ুও কম হয়। তাই এই রোগকে নির্মূল করার লক্ষ্যে সম্প্রতি জাতীয় মিশন ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়াও এ দেশের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের জনজাতি সমাজে এই রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। বর্তমানে দেশের প্রায় দশ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। দেবজ্যোতি বলেন, ‘‘এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু আক্রান্তের শরীরে রোগ থেকেই যায়। আক্রান্তকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে আক্রান্তের জিনগত প্রতিস্থাপন করার নীতি হাতে নেওয়া হয়েছে।’’

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, জিনগত চিকিৎসাকে কাজে লাগিয়ে রোগীর ডিএনএ-তে যে বিন্যাসজনিত সমস্যা রয়েছে, তা ঠিক করাই তাঁদের লক্ষ্য। এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রিসপর জিনোম এডিটিং পদ্ধতি। এই প্রযুক্তি হল জিনগত রোগ সংশোধন করার একটি কৌশল। এর মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ-তে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব হয়ে থাকে। সৌভিক-দেবজ্যোতিরা জানাচ্ছেন, ‘‘রক্ত তৈরি করা স্টেম কোষ (সেল) লুকিয়ে থাকে হাড়ের মজ্জা বা বোন ম্যারোর মধ্যে। প্রথম ধাপে রোগীর শরীরে একটি বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে হাড়ের মজ্জা থেকে স্টেম কোষগুলিকে বেরিয়ে রক্তে চলে আসে। সেই সময়ে রোগীর শরীর থেকে যদি রক্ত সংগ্রহ করা হয়, সে ক্ষেত্রে শরীরের রক্তের মধ্যে স্টেম কোষের উপস্থিতি অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। এর পরে সেই রক্তের মধ্যে থেকে স্টেম কোষগুলি আলাদা করে নেওয়া হয়। আলাদা করা ওই স্টেম কোষগুলির মধ্যে একটি ইলেকট্রিক পাল্‌স চালিয়ে জিন এডিট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যাস৯ প্রোটিন প্রবেশ করিয়ে দেন গবেষকেরা। যার কাজ হল কোষের ভিতরে প্রবেশ করে স্টেম কোষের ডিএনএ বিন্যাসের শৃঙ্খলে যে সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করে সেটিকে ঠিক করা।

অন্য দিকে রোগীর শরীরে যে ত্রুটিযুক্ত স্টেম কোষগুলি রয়ে যায়, সেগুলি ওষুধের মাধ্যমে (এক প্রকার কেমোথেরাপি) নষ্ট করে দেওয়া হয়। যাতে ওই স্টেম কোষগুলির ভবিষ্যতে খারাপ রক্তকণিকা উৎপাদন করার ক্ষমতা না থাকে। পরবর্তী ধাপে ত্রুটিহীন স্টেম কোষগুলি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপিত করা হয়। শেষ ধাপে ত্রুটিহীন ওই স্টেম কোষগুলি হাড়ের মজ্জায় প্রবেশ করে এবং সুস্থ লোহিত কণিকা উৎপাদন করা শুরু করে। যাকে হোমিং বলা হয়ে থাকে। দেবজ্যোতি আশা করছেন, ‘‘এর পরে ওই ব্যক্তি একেবারে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবেন।’’ এই গবেষণার কথা শুনে এমস-এর চিকিৎসক এস এন রাই-ও আশাবাদী। তাঁরও মত হল, এই বিশেষ রোগটির প্রকোপ জনজাতি সমাজের মধ্যেই বেশি। রোগটিকে নির্মূল করতে হলে জিন প্রযুক্তি কার্যকর হবে বলে তাঁর আশা। তবে বিষয়টি খরচসাপেক্ষ। সে দিকটিও মাথায় রাখা দরকার বলে তাঁর মত।

গবেষকরা জানাচ্ছেন, গোড়ায় রোগীর ডিএনএ-তে যে ত্রুটি রয়েছে তা গবেষণাগারে ঠিক করা হবে। যে কারণে আইজিআইবি অত্যাধুনিক মানের একটি গবেষণাগারও তৈরি করেছে। মানব শরীরের বাইরে জিন সংশোধনের ওই পদ্ধতিকে বলা এক্স ভিভো জিন থেরাপি। ভবিষ্যতে যাতে স্টেম কোষকে বাইরে না এনে মানব শরীরের অভ্যন্তরেই জিন সংশোধনের কাজ করা সম্ভব হয়, তার পথ খুঁজতে ফার্মা সংস্থা সিরামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গবেষণা করবেন দেবজ্যোতি-সৌভিকেরা। দেবজ্যোতির কথায়, ‘‘এক্স ভিভো পদ্ধতি খরচসাপেক্ষ। তাই ইন ভিভো পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে। এতে রোগীকে আর আমাদের কাছে আসতে হবে না। চিকিৎসাকে অনায়াসে রোগীর কাছে পৌঁছেদেওয়া সম্ভব।’’

আপাতত বাঙালি জুটির হাত ধরেই আশায় বুক বাঁধছেন সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্তরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন