হে সুধীজন! হে বঙ্গপুঙ্গবগণ! কার কথা বলা হচ্ছে এই স্মৃতিচারণে, হয়তো ঠাহর করতে পারছেন না। দুম করে তাঁর পরিচয় দিতে আমারও কেমন কষ্ট হচ্ছে। মরমে মরে যাচ্ছি লজ্জায়। শত হলেও আজকের কথা তো নয়! সেই ইংরিজি ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। সারা গৌড়ে তখন চূড়ান্ত অরাজকতা। খেয়োখেয়ি তথা মাৎস্যন্যায় চলছে রাজ্যজুড়ে। সেনবংশের আগে, পালবংশের প্রথম রাজা গোপালকে ‘রাজা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হল। সেই ষষ্ঠ শতকেই জন্ম এই বৃদ্ধার (অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলাভাষার ইতিহাস’ দ্রষ্টব্য)। আদর করে ‘মা’ বলে ডাকি আমরা। আমাদের গর্ববোধ বিজ্ঞাপিত করতে হলে, এঁকে আধো-অন্ধকার কুঠুরি থেকে শাড়ি-গয়নায় সাজিয়ে উজ্জ্বল ফোকাসের আলোয় এনে বলি,—‘মা’। আমাদের মাতৃভাষা।
দিনচারেক বাদেই মায়ের জন্মদিন। পয়লা বৈশাখ। বলি, আমরা মায়ের সুসন্তান, আমাদের ক’জনের মনে আছে সে কথা? কলকাতা-পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলে সারা পৃথিবীময় বাঙালিদের ক’জনের ঘরে আছে বাংলা ক্যালেন্ডার? হলফ করে বা বাজি রেখে বলতে পারি, ভারতবর্ষেই বহির্বঙ্গে তথা বিভুঁই-বিদেশে শতকরা দশজনের ঘরের কোনও দেওয়ালেই বাংলা ক্যালেন্ডার ঝোলানো নেই। বাংলা তারিখ-মাস-বছরের খবর নেওয়া হয় আন্দাজে। লন্ডন-প্যারিস-সিডনি-দুবাইতেও বঙ্গপুঙ্গবদের টনক নড়ে সেই ইংরিজি ক্যালেন্ডার থেকে।
—‘‘ডার্লিং! মার্চ ইজ ওভার। নতুন ফিনান্সিয়াল ইয়ার শুরু হয়েছে। এই এপ্রিলেই আমাদের নিউ ইয়ার পড়ছে। আই মিন....’’ বলে, পেছনে তাকিয়ে শৈশব হাতড়ায় প্রবাসের তালেবর বাঙালি। ‘নববর্ষ’ বা ‘পয়লা বৈশাখ’ খুঁজে খুঁজে হয়রান। না পেলে বা ব্যর্থ হলে তখন খোঁজ পড়ে অন্যান্য বাঙালির, যাঁরা ‘লোকাল কল’-এর চৌহদ্দির মধ্যেই আছেন। পুরোহিত বা পইতেধারী ব্রাহ্মণ হলে তো কথাই নেই। হাতড়ে জুতমতো কাউকে না পেলে এবং গরজ বেশি থাকলে—‘‘কল কলকাতা। পিসিমার কাছে পঞ্জিকা থাকে।’’
অর্থাৎ বুঝতেই পারা যাচ্ছে, আমাদের ‘মা’ এখন গোলাপি মলাটের পঞ্জিকার পাতায় ঠাঁই পেয়েছেন। অনেকটা আজকের আধুনিক মানবজাতির স্বভাবমতন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘‘ঈশ্বর থাকেন জলে’’। অথবা ছিমছাম ঘরগেরস্থালির কোনও কোণে, কুলুঙ্গিতে পুতুল রূপে সসম্মান সসম্ভ্রম অধিষ্ঠিত। সকালের মিনিট পাঁচেক নিত্য ফুল-বেলপাতা ও ধূপের ধোঁয়ায় বিরাজমান। ক’জন মানুষ-মানুষির মনের ঘরে সেই সর্বশক্তিমানের ঠাঁই জুটেছে, বলতে পারেন? প্রায় একই নিয়মে আমাদিগের ‘মাতাজি’কে আমরা ‘অপ্রয়োজনীয়’ বা ‘ব্যবহারের অযোগ্য’ হিসেবে ধরে নিয়ে তাঁর জন্মদিনকে, বা বলতে গেলে প্রায় স্বয়ং তাঁকেই বন্দি করে রেখেছি পঞ্জিকার পাতায় বা নিত্যকর্ম পদ্ধতির বাইরে দেওয়ালপঞ্জির খোপে খোপে। আমাদের, আজকের মধ্যবয়েসিদের, মধ্যেই কথ্য বাংলা কষ্টেসৃষ্টে টিকে আছে। তাও এই মুম্বই বা দিল্লি-বেঙ্গালুরু জাতীয় বহির্বঙ্গে, এখন থেকেই মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির টান টের পাই (না না, আমার নয় সুধীজন! মায়ের ভাষার), যখন একসঙ্গে অনেক কথা বাংলায় বলতে হয়। তখন ইংরিজি-মরাঠি-হিন্দি-কন্নড় ভাষার স্রোতের মধ্যে বিশেষ কোনও শব্দ হাতড়াতে অপটু ডুবুরির মতো হাবু খাই, ডুবু খাই। তল পাই না। পাই ভয়। সংস্কৃতের মতন না দশা হয় জননীর। ‘ডেড ল্যাংগোয়েজ’।
যদিচ, এঁর জন্মের পিছনে আদিতে কোথাও সংস্কৃতের নামগন্ধ নেই। তবু সংস্কৃতের মতনই এঁকে প্রায় ‘ডেড’ বিশেষণের তালিকাভুক্ত করার ইঙ্গিত আমি বিদেশে পেয়েছি। উত্তর মেরুর কাছাকাছি ‘স্টকহোম’ থেকে নিয়ে দক্ষিণ মেরুর গা ঘেঁষে অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনি, ক্যানবেরা এবং পার্থ-এও।
স্টকহোম শহরের পাঁচ তারকা রেস্তোরাঁ ‘আলেকজান্দ্রা’য় আমার খানতিনেক ছবি আছে দেওয়ালে। সেই সুবাদে ফুরসত মতন গিয়ে বসতুম ওখানে। সেদিন এক স্বল্পপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। নাম মনে থাকলেও বলব না। কারণ, পদবি বা সারনেমেই আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে—বাঙালি। চল্লিশোর্ধ্ব এই বঙ্গপুঙ্গবটিকে দেখতে একেবারে টকটকে লালমুখো সাহেব। আদব-কায়দা চালচলনও বিলেত-ঘেঁষা। কুড়ি-পঁচিশ বছর দেশের বাইরে আছেন। এঁর সঙ্গে সেদিন আর একজন ছিলেন। তিনি পাক্কা সুইডিশ। নাম, ইয়তে হস।
ওঁদের দু’জনের সঙ্গে কথায় কথায় মিস্টার হস জানতে চাইলেন—‘‘ইউ আর অলসো ইন্ডিয়ান! মাদার টাং ইজ ইন্দি, আই মিন, হিন্ডি?’’
—‘‘না, বাংলা।’’
ইয়তে সামান্য অবাক চোখে একবার আমাকে, একবার বঙ্গজটিকে দেখতে দেখতে জানতে চাইলেন,—‘‘বাট, ইন্ডিয়াজ মাদার টাং, আই মিন, ন্যাশনাল ল্যাংগোয়েজ ইজ ইন্ডি...’’
বঙ্গজটি ওঁর কথার জবাব দিলেন। শুনে আমি হতভম্ব। —‘‘ইয়েস! বেঙ্গলি, আই মিন ‘বং’ ওয়াজ এ ভেরি ওল্ড পপুলার ল্যাংগোয়েজ, লাইক স্যাংস্কৃট। নাউ অনলি সাম ট্রাইবস ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ইউজ ইট অ্যাজ লোকাল লিংগো...’’
আমার অবস্থা তখন সুকুমার রায়ের হেডআপিসের বড়বাবুর মতন— ‘‘ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি, মুখ্যুগুলোর মুন্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি’’!
আমাদের মাতৃভাষার ব্যুৎপত্তি সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত থেকে। সঠিক বলতে গেলে, ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে মগধের প্রচলিত ভাষা, মাগধিপ্রাকৃৎ থেকে। এবং ‘পয়লা বৈশাখ’ বা বাংলা ‘নববর্ষ’ উদযাপন শুরু হয়েছিল জমিদারদের উদ্যোগে। জমিদাররা বছরের প্রথম দিনটা শুভ ধরে নিয়ে পূজাপাঠের ব্যবস্থা করতেন। নেমন্তন্ন করতেন ঢালাও। ‘পেটুক’ বা গৌরবে ‘ভোজনবিলাসী’ হিসেবে বাঙালির নাম সর্বজনবিদিত। গ্রাম-কে-গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ হাজির হতেন জমিদারবাড়িতে। আগেকার দিনের নিয়ম অনুযায়ী প্রজারা কেউ খালিহাতে যেতেন না। কিছু না কিছু সঙ্গে নিতেন। কলাটা মুলোটা, খেতের লাউ-কুমড়ো-বেগুন। বাংলা নববর্ষ উৎসবকে উপলক্ষ হিসেবে ধরে নিয়ে প্রজাদের ভরপেট খাইয়ে, নতুন বছরের খাজনা আদায় করে নিতেন জমিদাররা। তারই খানিকটা রেশ এখনও কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মফসসলে কমবেশি চলে আসছে। ব্যবসাবাণিজ্য বা দোকানপাটে খদ্দেরদের ‘পুণ্যা’য় (পুণ্যাহ) নেমন্তন্ন করে, মন্ডামিঠাই খাইয়ে বকেয়া উশুল তথা লেনদেন শুরু করা হয়। নতুন খাতায় ‘ওঁ গণেশায় নমঃ’ লিখে হিসেবপত্তরের আরম্ভ। হালের খাতা বা ‘হালখাতা’র গোড়াপত্তন।
ধীরে ধীরে সব চুপসে নাম-কা-ওয়াস্তে হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ক্যালেন্ডারের মতন ‘ফেড আউট’ হয়ে যাচ্ছে বাংলা ও বাঙালির আদি আচার-আচরণ ও সহবত।
মধুরেণ সমাপয়েত!
একটি ভয়ঙ্কর ‘জোক’ শুনিয়ে শেষ করব এ বছরের মতন। ‘‘আ’ মরি বাংলা ভাষা!’’
পটাইবাবুর নাতি ঝিংকু কলকাতার একটি নামী ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে। ঝিংকুকে তার সেই নামী স্কুল থেকে ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’র ওপর একটি রচনা লিখতে বলা হয়েছে। ঝিংকু সেই রচনাটি লিখে আজ সকালে তার দাদুকে পড়তে দিল।
‘টুডে ইজ একুশে ফেব্রুয়ারি’
‘‘আজ বাংলা ভাস্যা দিবস। মানে বাংলা ভাস্যার জন্মদিন। নাইন্টিন ফিফটি টু-এর টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি আরসহোয়াইল ইস্ট পাকিস্তানে বাংলা ভাস্যার জন্ম হয়েছিল। অবশ্য এই ভাস্যার জন্মের সময় অনেক প্রব্লেম হয়েছিল, অনেক ফাইট হয়েছিল, তাতে অনেক লোক মরে গেছিল। আমাদের স্কুলে আজ তাদের জন্য প্রে করা হবে আর বাংলা ভাস্যার হ্যাপি বার্থ ডে সেলিব্রেট করা হবে। অবশ্য বাংলা ভাস্যা আগেও একবার জন্মেছিল। সেবার মিঃ রবিন্দ্রনাথ টেগর নামে এক ভদ্রলোক এই বাংলা ভাস্যায় গান লিখে নোবেল প্রাইজ উইন করেছিলেন। উই আর প্রাউড অফ মিঃ আর এন টেগোর। এই ভাস্যা এতটাই ভাল যে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে এমনকী বিগ বি’র মত সেলিব্রিটিরাও এই ভাস্যায় গান গেয়েছেন। শাহরুখ খানের মত হ্যান্ডসামও বলেছেন—আমি বাংলাকে বালোবাসি। বিদ্যা বালনও বাংলাভাস্যাকে ভালবেসে বাংলা সিনেমায় হিরোইন হয়েছেন। আমার বিদ্যা বালনকে খুব ভাল লাগে। আর আমার মা তো শাহরুখ খানের জন্য পুরোপুরি পাগল।’’
তবে রচনাটি এখনও পর্যন্ত স্কুলে জমা পড়েনি, কারণ এই লেখাটি পাঠ করামাত্র পটাইবাবু জ্ঞান হারান...এবং এখনও পর্যন্ত তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। আমি এখন পটাইবাবুর মাথার কাছে বসে আছি।...এবং মাথায় হাওয়া করে যাচ্ছি।