সঙ্কটে: হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আহতকে। মুম্বইয়ে। ছবি: রয়টার্স।
ব্রিটিশ আমলের জীর্ণ, সরু, ভিড়ে ঠাসা ফুটব্রিজটার ছবি মাত্র দু’দিন আগে টুইট করেছিলেন মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনের এক নিত্যযাত্রী। নতুন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে ছবিটা ‘ট্যাগ’ করে লিখেছিলেন, ‘কিছু করুন।’ গত বছরের জুলাইয়ে একই ফুটব্রিজের ছবি আর এক নিত্যযাত্রী ‘ট্যাগ’ করেছিলেন গয়ালের পূর্বসূরি সুরেশ প্রভুকে। এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও। লিখেছিলেন, ‘পরেল স্টেশনের অবস্থাটা কি পদপিষ্ট হওয়ার মতো নয়?’
সেই ভয়ানক আশঙ্কাটাই শুক্রবার সত্যি হয়ে গেল। নবমীর সকালে মুম্বইয়ের পরেল এবং এলফিনস্টোন রোড স্টেশনের সংযোগকারী ওই পুরনো ফুটব্রিজেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ৮ মহিলা-সহ ২২ জন। আহত ৩৯।
আর দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে রেল জানাল, নতুন ফুটব্রিজ তৈরির টেন্ডার ডাকা হয়েছে এ দিনই! সর্বশেষ রেল বাজেটে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু নতুন ফুটব্রিজ তৈরিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই এগোয়নি। ঘটনাচক্রে প্রাক্তন ও বর্তমান, দুই রেলমন্ত্রীই মুম্বইকর। গয়াল এ দিন নিজের শহরেই ছিলেন। নয়া রেল প্রকল্প ঘোষণা করার বদলে মৃতদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথা জানাতে হয়েছে তাঁকে। একই অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসও।
মধ্য রেলের স্টেশন পরেল এবং পশ্চিম রেলের এলফিনস্টোন জোড়া রয়েছে ওই ফুটব্রিজ দিয়ে। শুক্রবার দুর্ঘটনা ঘটে ব্রিজ থেকে এলফিনস্টোনে নামার মুখে। রেল এবং আরপিএফ সূত্রের দাবি, প্রবল বৃষ্টি আর দমবন্ধ ভিড়ের মধ্যে পরপর দু’টো গুজবই বিপদ ডেকে আনে।
প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল এ দিন সকালে। তখন প্রায় পৌনে এগারোটা। দুই স্টেশনে একই সঙ্গে এসে দাঁড়ায় চারটি ট্রেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বহু যাত্রী তখন ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেন আসার পরে তাঁদের অনেকে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে যান। আবার ট্রেন থেকে নেমে অনেকে হুড়োহুড়ি করে উঠতে যান ব্রিজে। এই সময়েই নাকি গুজব রটে— ভিড়ের চাপে ব্রিজের একটা দিক ভেঙে পড়ছে। গুজবের আতঙ্কে শুরু হয় ঠেলাঠেলি। বৃষ্টিতে এমনিতেই পিছল ছিল ব্রিজ। অনেকে পড়ে যান। আর উঠতে পারেননি।
আরও পড়ুন: গুজবে হুড়োহুড়ি, মুম্বইয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত অন্তত ২২
যাত্রী ও পুলিশের একাংশের অবশ্য দাবি, ওই সময়েই বিস্ফোরণের মতো একটি জোরালো শব্দ হয়। কিছু লোক চিৎকার করে বলেন, ‘‘শর্ট সার্কিট হয়েছে। লোহার ব্রিজে বিদ্যুৎ চলে আসতে পারে।’’ এতেও অনেকে ভয় পেয়ে দৌড়নোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ রেলিং টপকে নীচে ঝাঁপ দিতে যান। উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার আগেই দেখা যায়, ভিড়ের মধ্যে প্রায় অচেতন একের পর এক মুখ। পরেলের কেইএম হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে নিয়ে আসার আগেই ২২ জনের মৃত্যু হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন মহিলা। বিকেলেও ফুটব্রিজের আশপাশ জুড়ে পড়ে ছিল চটি-জুতোর স্তূপ।
ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। শোকবার্তা পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোক প্রকাশ করেও কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী রেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুষেছেন। যাত্রীদের বক্তব্য, গত দশ বছরে যে হারে রেলে যাতায়াত করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, পুরনো ফুটব্রিজটি সেই অনুপাতে প্রস্থে খুবই কম। তাই অনেক দিন ধরেই নতুন, চওড়া একটি ফুটব্রিজের দাবি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু নড়ে বসেনি রেল। পরেল এলাকাটি অফিসপাড়া হওয়ায় এমনিতেই ভিড় লেগে রয়েছে। আর ওই ফুটব্রিজ দিয়ে শুধু রেলযাত্রীরা নন, সাধারণ মানুষও আসা-যাওয়া করেন। এ দিন বৃষ্টির জন্য সেই ভিড়ও গিয়েছিল বেড়ে।
তার পরেই বিপর্যয়।