নিশানায় জঙ্গি। রবিবার উরিতে পিটিআইয়ের ছবি।
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই গন্ধটা পাচ্ছিলাম। গা-গুলোনো পোড়া গন্ধ একটা। পোড়া ডিজেল, পোড়া কাপড়— সব মিলেমিশে। তখনও জানি না, ঘুমন্ত ক’টা মানুষও পুড়েছে ওই আগুনে।
ভোরে হামলার খবরটা পেয়েই হুড়মুড় করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। যে করেই হোক পৌঁছতে হবে উরির সেনা ঘাঁটিতে। এক সহকর্মী বললেন, সঙ্গে যাবেন। যদিও বলা যতটা সোজা, যাওয়া ততটা নয়। আমাদের যেখানে বাড়ি, সেই শ্রীনগরে এখন কার্যত বন্ধ চলছে গত দু’মাস ধরে। দোকানপাট সব বন্ধ। অনেক সাধ্যসাধনার পর একটা গাড়ি যেতে রাজি হল। চাইল তিন হাজার টাকা। উপায় নেই। চলো উরি।
বারামুলা পর্যন্ত এসেই দেখি চারপাশ কেমন থমথমে। সেনার গাড়ি ছাড়া একটাও অন্য গাড়ি নেই কোথাও। লোকজনও নেই। উরি এখনও অনেকটা পথ। আমরা এগোতে লাগলাম। জওয়ানরা আমাদের দেখলেন, কিন্তু বাধা দিলেন না। ১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় পৌঁছব-পৌঁছব করছি, এমন সময়েই পোড়া গন্ধটা পেলাম। যত এগোচ্ছি, তীব্র হচ্ছে সেই গন্ধ।
মিনিটখানেক হবে বড়জোর। দূরের পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে বিস্ফোরণের আওয়াজটা কানে এসে পৌঁছল এ বার। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাত দেখিয়ে আমাদের গাড়িটা থামিয়ে দিলেন এক জওয়ান। দেখলাম, ব্যারিকেড তুলে দেওয়া হয়েছে সামনের রাস্তায়। ‘‘আগে খতরা হ্যায়’’— বললেন জওয়ান। ব্যারিকেডের ও-পারে তাঁর সহকর্মীদের ভারী বুটের শব্দ।
ঘড়ি বলছে, সকাল ৮টা ৫০। সেনা ঘাঁটি এখনও প্রায় দেড় কিলোমিটার। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আর নামতেই চোখ গেল দূরের পাহাড়ে। দৃশ্যটা লিখে বোঝানো কঠিন। ঘন সবুজে ছাওয়া দু’টো পাহাড়। তার ফাঁকে পিকচার পোস্টকার্ডের মতো সবুজ-হলুদ ছাউনির ছিটেফোঁটা। বড় বড় কয়েকটা গাছ। ওই গাছগুলোর পেছন থেকেই ধোঁয়াটা উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। কালো, ধূসর, সাদা— অনেক রং সেই ধোঁয়ার! ওই ধোঁয়া ভেদ করেই যেন শব্দ আসছে ‘বুম.. বুম’! গ্রেনেড না আইইডি, কে জানে। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলির আওয়াজও পাচ্ছি মাঝে মাঝে।
সেনার চপারগুলো টানা চক্কর দিচ্ছে মাথার ওপরে। একটু দূরেই রাজ্য পুলিশের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপের গাড়ি। কিন্তু পুলিশকে নাকি ভেতরে যেতে দিচ্ছে না সেনা। শুনলাম, জঙ্গি মোকাবিলায় আকাশ থেকে নামানো হচ্ছে প্যারা-কম্যান্ডো। সবই শুনছি এ দিক-ও দিক থেকে। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের সুবিধে যাতে জঙ্গিরা নিতে না পারে, তাই চ্যানেলের ওবি ভ্যানগুলোকেও এখানে আটকে দেওয়া হয়েছে। যদিও তত ক্ষণে আমরা জেনেছি, জওয়ানদের তাঁবুতে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন লাগিয়ে তারপর ব্রাশ ফায়ার করেছে জঙ্গিরা। এখন কাছাকাছিই কোথাও লুকিয়ে গুলি ছুড়ছে তারা। জবাব দিচ্ছে সেনা।
ঠিক পৌনে দশটা নাগাদ আমাদের আরও একটু এগোনোর অনুমতি দেওয়া হল। গুলিগোলা তখন থেমেছে। জনা চারেক জঙ্গি নাকি মারাও পড়েছে। সেনা ঘাঁটির মোটামুটি একশো গজ দূরে দ্বিতীয় ব্যারিকেড। আগুন-ধোঁয়া— সবই সেখান থেকে অনেক স্পষ্ট। ভেতরে যেতে চাইলাম। রাজি হলেন না প্রহরারত জওয়ান। বললেন, ‘‘এই চত্বরে আর কোনও জঙ্গি নেই। কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন, ঠিক পেছনেই ঘন জঙ্গল। সেখানে এখন চিরুনি তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে, কেউ লুকিয়ে আছে কি না। আপনারা এগোলে কিন্তু বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলবেন।’’
অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। এই সময়ে হঠাৎ দেখি, সামনের রাস্তা ধরে দু’এক জন সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসছেন। এক জন সদ্য-যুবক। আলাপ করে জানা গেল, তাঁর নাম আকিব। কাছেই বাড়ি, পড়েন দ্বাদশ শ্রেণিতে। বললেন, ‘‘ভোর সওয়া ৫টা নাগাদ গুলির আওয়াজ ঘুম ভেঙে গেল। ভেবেছিলাম, পাক সেনা আবার নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষবিরতি ভেঙেছে। মাঝেমধ্যেই এমন হয়। কিন্তু আজ বিস্ফোরণ আর গুলির আওয়াজ বন্ধ হল না। তখন ভাবলাম, মাটির নীচের বাঙ্কারে ঢুকে পড়ি। এখানে তো সাধারণ লোকের জন্যও ওরকম বাঙ্কার রয়েছে। তখনই শুনি, মসজিদের মাইক্রোফোনে সেনার তরফে ঘোষণা হচ্ছে, জঙ্গি হামলা হয়েছে। আমরা যেন বাড়ির দরজা এঁটে বসে থাকি।’’ কাছেই ছিল আর এক স্কুলপড়ুয়া মহম্মদ ইরফান। বলল, ‘‘এত জোর বিস্ফোরণ হচ্ছিল, ভাবলাম ঘরবাড়ি উড়ে না যায়। আর ঘুমোতে পারিনি।’’
বেলা বাড়ছে। কমে আসছে ধোঁয়াও। এক সময়ে খবর পেলাম, সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ আসছেন উরিতে। ফের অপেক্ষা। যদি কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেন সেনাপ্রধান। সে সব অবশ্য কিছুই হল না। সেনাপ্রধান ও অন্য সেনা কর্তারা হেঁটেই ঢুকে গেলেন আক্রান্ত ঘাঁটিতে।
সা়ড়ে তিনটে। আলো থাকতে থাকতেই আমাদের ফিরতে হবে শ্রীনগরে। অতএব এ বার ফিরতি পথ ধরা। পাহাড়ি জঙ্গলে তখনও চলছে তল্লাশি অভিযান। মনে পড়ছিল আকিবের কথাগুলো— ‘‘এই হামলাটা হওয়ায় খুব খারাপ লেগেছে আমার।’’ গত দু’মাস ধরে শ্রীনগর-সহ উপত্যকার নানা জায়গায় দেখেছি, নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ করে পাথর ছুড়ছে জনতা। আর উরি? এখানকার সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশই জড়িত এই সেনাঘাঁটিটার সঙ্গে। কারও বাবা ছাউনির ক্যান্টিনে কাজ করেন। কেউ পোর্টার। কেউ মিস্ত্রি। যতক্ষণ ছিলাম, ওই পোড়া গন্ধের সঙ্গেই যেন মিশছিল তাঁদের দমচাপা বিষণ্ণতা।
ধোঁয়ার জাল পেরিয়ে আমাদের অন্য ‘উরি-দর্শন’ হল আজ।
সতর্কতা বিমানবন্দরে
কাশ্মীরের উরিতে সেনাঘাঁটিতে জঙ্গিহামলার ঘটনায় কলকাতা বিমানবন্দরেও জারি করা হল বিশেষ সতর্কতা। বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা সিআইএসএফের অতিরিক্ত জওয়ানকে লাগানো হয়েছে বিমানবন্দরে তল্লাশির দায়িত্বে। বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে ঢোকা প্রতিটি গাড়িতে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। মেটাল ডিটেক্টর ছাড়াও তল্লাশির কাজে রয়েছে বিশেষজ্ঞ কুকুর। এমনকী কোনও গাড়িকেও বিমানবন্দরের টার্মিনালের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না।
যে সব যাত্রী বিমানবন্দরে ঢুকেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই মালপত্র এক্স-রে মেশিনে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। টার্মিনালের ভিতরে সন্দেহভাজন কেউ রয়েছেন কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য বেশ কিছু সাদা পোশাকের নিরাপত্তারক্ষীও মোতায়েন করা হয়ছে কলকাতা বিমানবন্দরে।