কামাখ্যা মন্দিরে দেওধনী নৃত্য। ছবি: এএফপি।
স্বাধীনতার পর গত ৭০ বছরে যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে ভারত, সেই সমৃদ্ধি অর্জন করা যাবে আগামী তিরিশ বছরেই। তবে তার জন্য ছাড়তে হবে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর লিঙ্গ বৈষম্য। ধর্মনিরপেক্ষতাই গড় জাতীয় উৎপাদন বাড়ানোর সব থেকে সহজ দাওয়াই। সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নাল-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এল এমনই তথ্য। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় আর আমেরিকার টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই যৌথ গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর উন্নতিতে মানুষের বিশ্বাসের ভূমিকা’।
বিশ্বের ১০৯ দেশকে নিয়ে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে ৬৬ তম স্থানে ভারত, এক নম্বরে চিন। পাকিস্তান রয়েছে ৯৯ তম স্থানে, বাংলাদেশ ১০৪-এ। তালিকায় একদম শেষে ঘানা, অর্থাৎ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সব থেকে বেশি আফ্রিকার এই দেশে। ঘৃণা মিশ্রিত অপরাধের সংখ্যা গত এক দশকে বহুগুণ বাড়লেও তালিকায় ৫৭ নম্বরে আছে আমেরিকা।
‘‘১৯৫৮ থেকে ২০১৮, এই ৬০ বছরে ভারতের গড় জাতীয় উৎপাদন ২৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি আর লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে পারলে এই উৎপাদন আরও অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’’ এমনটাই জানাচ্ছেন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডামিয়েন রক।
কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের উৎপাদনের সম্পর্ক কোথায়? এখানেই আসছে সমাজের দুটি অংশের ভূমিকা। গবেষকরা মনে করছেন, ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেই উৎপাদন ও সমৃদ্ধির মূল স্রোতে নেই দেশের নারী ও দলিত সমাজ। যা কমিয়ে দিচ্ছে উন্নতির গতি। ভারত সরকারের ‘জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা’-র তথ্যের নিরিখে দেশের দরিদ্রতম সমাজের ৪৬ শতাংশই তফসিলি উপজাতি আর ২৭ শতাংশ তফসিলি জাতির সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ, দেশের আর্থিক উন্নয়নে তাঁদের কোনও ভূমিকা নেই। আবার দেশের উন্নয়নের কোনও সুফলই তাঁরা পাচ্ছেন না।
ভারতের সংস্কৃতিতে এখনও মহিলাদের ঘরের বাইরে কাজ করা নিয়ে বেশ কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধ আছে। ‘ইন্ডিয়া স্পেন্ড’ জার্নালের একটি অন্তর্তদন্তে দেখা যাচ্ছে, ভারতে মহিলাদের মাত্র ২৭ শতাংশ কর্মরত, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সব থেকে কম। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টের হিসেবেও ২০০৪ থেকে ২০১১, এই সাত বছরে ভারতে কাজ ছেড়েছেন এক কোটি ৯৬ লক্ষ মহিলা।
গবেষক রক অর্থনীতির যে মডেল বানিয়েছেন, তাতে ভারতের মাথা পিছু বাৎসরিক আয় হওয়া উচিত ছিল চার লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা, যা বাস্তবের থেকে অনেক টাই বেশি। তবে এখনও সে রাস্তায় হাঁটার উপায় আছে মনে করছেন গবেষকরা। কারণ, এই পথেই আছে অভাবনীয় সমৃদ্ধির সম্ভাবনা।
ধর্মনিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে ১০৯ টি দেশের মধ্যে ছয় নম্বরে রয়েছে জার্মানি। অর্থাৎ বেশ উপরের দিকেই। পশ্চিম ইউরোপের এই দেশটির মতো সহিষ্ণু হতে পারলে ভারতের মাথাপিছু উৎপাদন আগামী দশ বছরে প্রায় ৭০ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে। আগামী ২০ বছরে তা বাড়বে প্রায় এক লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। আর ৩০ বছর পরে মাথা পিছু উৎপাদন বাড়বে তিন লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এমনটাই হিসেব কষে দেখিয়েছেন গবেষকেরা।
১৯৫৮ থেকে ২০১৮, এই ৬০ বছরে ভারতের মাথা পিছু গড় জাতীয় উৎপাদন ৪,৯৮২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১,৩৮,৬০০ টাকা। অর্থাৎ, জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে ২,৬৮২ শতাংশ। শতাংশের হিসেবে একই পরিমাণ বৃদ্ধি ভারত অর্জন করতে পারবে অর্ধেক সময়ে, মাত্র ৩০ বছরে। তবে তার জন্য গোঁড়ামি ছেড়ে মুক্ত করতে হবে দেশকে।
তবে পথটা সহজ নয়, কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষের অন্তরাত্মায় মিশে আছে এবং সময়ের সঙ্গে তা বাড়ছে। ‘ওয়ার্ল্ড ভ্যালু’ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ ধর্মকে তাঁদের জীবনের ‘ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় বলে মনে করেন। ভারত আর কিরঘিজস্তান এমন দু’টি দেশ, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। ২০০৪ সালে ৭৯.২ শতাংশ ভারতীয় মনে করতেন, ধর্ম তাঁদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার বদলে আর বেশি করে ধর্মের নাগপাশে জড়াচ্ছে দেশ।
আরও পড়ুন: কেরলের বন্যা মানুষের তৈরি?
মহিলাদের গড় জাতীয় উৎপাদনও ভারতে শোচনীয় ভাবে কম। চিলি, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশও ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে। পুরুষ ও মহিলাদের আয়ের বিশাল ফারাক হওয়ায় দেশের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষ উন্নতির সুফল ভোগ করতে পারছেন না। যা প্রগতির পথে বিরাট অন্তরায় বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
আরও পড়ুন: গো-রক্ষার নামে হিংসা ৪১৫০% বাড়ল এই জমানায়!
অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা মুক্তমনা হওয়ায় দাওয়াই দিলেও সাম্প্রতিক কালে উল্টো পথেই হাঁটছে ভারত। গত কয়েক বছরে দেশে ক্রমাগত বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, বাড়ছে ঘৃণামিশ্রিত অপরাধের সংখ্যা। ২০১৭ সালে সারা দেশে ধর্মীয় হিংসার বলি হয়েছেন ১১ জন। ঘৃণামিশ্রিত অপরাধের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭। অর্থাৎ, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ভুল দিশায় বড়সড়় লাফ দিচ্ছে ভারত।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)