ষাঁড়ের লড়াইয়ে নতুন বিতর্ক উস্কে দিলেন বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী।
তামিলনাড়ু বিধানসভায় আইন পাশ করে যখন জাল্লিকাট্টু সমস্যা মেটানোর ব্যবস্থা প্রায় পাকা, তখন সোমবার দুপুরে রাজ্যসভা সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দাবি করে বসেন, জাল্লিকাট্টু নিয়ে আন্দোলনের পিছনে রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। স্বামী দাবি তোলেন, অশান্ত তামিলনাড়ুতে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। বিক্ষোভকারীদের হটাতে প্রয়োজনে আধাসেনা বা সেনা নামাতে হবে।
স্বামীর এই টুইট রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কারণ এডিএমকে তাদের জোটসঙ্গী। তামিলনাড়ুতে বিজেপির আলাদা করে তেমন সাংগঠনিক শক্তিও নেই। অরুণ জেটলি ও রাজনাথ সিংহের মতো নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিচ্ছেন, স্বামীর বক্তব্য অবজ্ঞা করা হোক। তামিলনাড়ুর সমস্যা সে রাজ্যের মানুষ মেটাবেন, সেটাই কাম্য। কেন্দ্র নাক গলাচ্ছে, এই বার্তা গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তাই স্বামীকে আপাতত ওই ধরনের টুইট করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। কারণ যে সমস্যা তামিলনাড়ুতেই সীমাবদ্ধ, তা দিল্লিতে আছড়ে পড়ুক তা আদৌ চাইছেন না দলের শীর্ষ নেতারা।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ষাঁড়ের লড়াই ঘিরে তামিল জনতাই বা এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন? কেউ বলছেন, কেন্দ্রের দীর্ঘ বঞ্চনার ফল। কারও মতে, মানুষের হাতে যথেষ্ট কাজ-কর্ম বা চাকরি না থাকার জের। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের মতে, সমাজে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু চাকরির সংস্থান হয়নি। আর সেই কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। তিনি টুইট করে জানিয়েছেন ‘‘মহারাষ্ট্রে মরাঠা এবং হরিয়ানায় জাঠদের সংরক্ষণের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, জাল্লিকাট্টু প্রতিবাদও সেই রকমই। কর্মসংস্থান না হওয়ারই ফল এগুলি।’’
মেরিনা সৈকতে গত ক’দিন ধরে হাজার হাজার পোস্টার ব্যানার বলছে, ‘‘আমরা ভারতীয় মাত্র ৭০ বছর। কিন্তু ৫০০০ বছর ধরে আমরা তামিল।’’ বিশ্লেষকেরা বলছেন, তামিল জাতিসত্তা এবং তাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে দীর্ঘদিন মর্যাদা না দেওয়ার ফলে যে ক্ষোভ জমা হয়েছে, এটা তারই প্রকাশ। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর আঝাগারাসন বলছেন, ‘‘আমরা আসলে যা দেখছি, তা হল তামিলদের সম্মিলিত ক্ষোভ। কেন্দ্রীয় সরকারের বছরের পর বছর ধরে এই রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার ফলাফল। তা সেটা তামিলনাড়ুর মৎস্যজীবী সংক্রান্ত সমস্যা হোক, তামিল ইলম অথবা কাবেরী জলচুক্তি। জাল্লিকাট্টুর প্রতি এই নিষেধাজ্ঞাকে অনেকেই দেখছেন তামিল বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে।’’
বছর চারেক আগে নির্ভয়া কাণ্ডের তুলনাও টানছেন অনেকে। সেখানে একটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সার্বিক জনরোষে পরিবর্তিত হয়ে রাজধানীকে উত্তাল করেছিল। তামিল লেখক তথা সামাজিক আন্দোলনকারী স্ট্যালিন রাজাঙ্গমের মতে, ‘‘এই রাজ্যে আরও বড় বড় সামাজিক সমস্যার বিষয় রয়েছে। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষ এ ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেননি। কারণ সেগুলি আগেই পকেটে পুরে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। এখানে এখনও তারা ঢুকতে পারেনি বলেই মানুষের আবেগের দিকটি বেশি করে প্রকাশ পাচ্ছে।’’
আর একটি ব্যাখ্যা রাজনৈতিক শূন্যতা। তামিলনাড়ুতে দীর্ঘদিন ধরে দাপট ছিল বড় দু’টি আইকনের। কারও ভরসা ছিলেন ‘আম্মা’ জয়ললিতা। বাকিদের আস্থা করুণানিধির প্রতি। আম্মা প্রয়াত। করুণানিধিও অবসরে। এই শূন্যতার কারণেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ডাকে প্রায় আরব বসন্তের মতো সমাবেশ জেগে উঠেছে মেরিনা সৈকতে। তারকারা দলে দলে সামিল হলেও জনতাই সেখানে নায়ক। এডিএমকে-ডিএমকে, দুই শিবিরের নেতানেত্রীরা এই ক’দিন শুধু নিজেদের কোলে ঝোল টানার চেষ্টা করে গিয়েছেন মাত্র।
তবে জয়ললিতার মৃত্যুর পর শশিকলা দলের প্রধান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চেন্নাইয়ের কিছু সূত্রের বক্তব্য, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শশিকলার সুসম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও সে ভাবে এই আন্দোলনে ঢুকতে না পারলেও কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সেই চেষ্টা প্রবল ভাবে হবে বলেই মনে করছেন অনেকে। ইতিমধ্যেই বেঙ্কাইয়া নায়ডু ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি তামিলনাড়ুর মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে এই খেলা জড়িয়ে রয়েছে। এতে কারও আপত্তি করার কোনও কারণ নেই।’’