অন্ধ্রপ্রদেশে দু’বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের এক ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। —প্রতীকী চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের এক ছাত্রীর অন্ধ্রপ্রদেশে রহস্যমৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আদালত। এই ধরনের ঘটনাগুলি কমাতে দেশের সর্বত্র স্কুল, কলেজ, হস্টেল, কোচিং সেন্টার-সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৫ দফা গাইডলাইন বেঁধে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
পড়ুয়াদের আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন আদালত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকেও জোর দিতে বলেছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবনের অধিকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকার। দু’বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। বিশাখাপত্তনমের এক কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল ওই ছাত্রী। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে হস্টেলের চারতলার ছাদ থেকে পড়ে যায় সে এবং পরে মৃত্যু হয় ওই ছাত্রীর। আইনি খবর পরিবেশনকারী ওয়েবসাইট ‘বার অ্যান্ড বেঞ্চ’ অনুসারে, ওই ঘটনায় পুলিশের একপেশে তদন্তের অভিযোগ তুলে সিবিআই তদন্তের দাবি জানান মৃতের বাবা। অন্ধ্রপ্রদেশ হাই কোর্টে ওই আর্জি খারিজ হয়ে গেলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। শুক্রবার ওই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ।
আদালত জানিয়েছে, দেশে পড়ুয়াদের আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ভাবে একটি আইনি পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী অন্য জায়গা থেকে রাজস্থানের কোটা, জয়পুর, সিকার, অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম, তেলঙ্গানার হায়দরাবাদ এবং রাজধানী দিল্লিতে আসেন। তাঁদের ভীষণ ভাবে মানসিক চাপের মুখে পড়তে হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁদের সুরক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আদালতের পর্যবেক্ষণ, পড়ুয়াদের উপর বোঝা চাপানো শিক্ষা ব্যবস্থার কাজ নয়। এর থেকে মুক্তি দেওয়াই হল শিক্ষা ব্যবস্থার কাজ।
‘গ্রেড’ বা ‘র্যাঙ্কিং’ নয়, পড়ুয়াদের সামগ্রিক বিকাশেই এর প্রকৃত সাফল্য বলে জানিয়েছে আদালত। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রায়শই পড়ুয়াদের মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে বলেও মনে করছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। আদালতের পর্যবেক্ষণ, শেখার আনন্দের পরিবর্তে এখন সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে র্যাঙ্কিং, ফলাফল এবং পারফরম্যান্স মেট্রিক্স নিয়ে উদ্বেগ। পড়ুয়াদের আত্মহত্যার ঘটনা রুখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য ১৫ দফা গাইডলাইনও বেঁধে দিয়েছে আদালত।
এক, ‘উম্মীদ’-এর খসড়াবিধি, ‘মনোদর্পণ’-এর উদ্যোগ এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অনুসারে একটি অভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করতে হবে। এই মানসিক স্বাস্থ্যনীতিকে প্রতি বছর পর্যালোচনা করে সেটি ‘আপডেট’ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এবং নোটিস বোর্ডেও সেটি থাকতে হবে।
দুই, প্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন মনোবিদকে নিযুক্ত করতে হবে।
তিন, পড়ুয়ারা যাতে সেই মনোবিদের থেকে সব রকম সুবিধা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে।
চার, শিক্ষাগত পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পড়ুয়াদের ব্যাচ ভাগ করা চলবে না।
পাঁচ, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্থানীয় হাসপাতাল এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বরগুলি হস্টেল, শ্রেণিকক্ষ, কমন এরিয়া এবং ওয়েবসাইটে লেখা থাকতে হবে।
ছয়, প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীকে বছরে অন্তত দু’বার পেশাদার মনোবিদের কাছে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
সাত, প্রত্যেক শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মীরা যাতে পড়ুয়াদের বিষয়গুলি সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আট, জাতি, গোষ্ঠী বা লিঙ্গের ভিত্তিতে হয়রানি, যৌন নির্যাতন, হেনস্থা বা র্যাগিংয়ের মতো ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে যাতে পড়ুয়ারা সহজে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ করতে হবে। এই ধরনের ক্ষেত্রে সময়মতো পদক্ষেপ না করলে বা অবহেলা হয়ে থাকলে তা আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি হিসাবেই তা গণ্য হবে।
নয়, পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নিয়মিত ভাবে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। পড়াশোনার চাপ , মানসিক যন্ত্রণার কোনও লক্ষণ পড়ুয়াদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কি না, সে দিকে অভিভাবকদেরও নজর রাখার পরামর্শ দিতে হবে।
দশ, পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি করে বার্ষিক রেকর্ড তৈরি করে রাখতে হবে।
এগারো, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলো, শিল্পকর্ম এবং পড়ুয়াদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকেও নজর দিতে হবে। পড়ুয়াদের উপর চাপ কমাতে পরীক্ষার ধরন নিয়েও পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বারো, পড়াশোনার পরে পেশাগত জীবনের শুরুর বিষয়ে পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের নিয়মিত পরামর্শ দিতে হবে।
তেরো, হস্টেলগুলিতে যাতে কেউ হেনস্থার শিকার না হন, সেখানে যাতে মাদক বা অন্য কোনও ক্ষতিকারক জিনিস প্রবেশ না করে, সে দিকে নজর রাখতে হবে হস্টেলের মালিক, কেয়ারটেয়ার এবং ওয়ার্ডেনদের।
চোদ্দ, প্রতিষ্ঠান বা হস্টেলের সিলিং ফ্যানগুলিতে নির্দিষ্ট কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা বসাতে হবে। ছাদ, বারান্দা বা অন্য কোনও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
পনেরো, জয়পুর, কোটা, সিকার, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, দিল্লি, মুম্বই-সহ যে সব শহরে অন্য জায়গা থেকে পড়ুয়ারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আসেন, সেখানে প্রতিটি জায়গায় কোচিং সেন্টারগুলিতে পড়ুয়াদের মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।