পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। শরশয্যায় শুয়ে ঘোষণা করেছিলেন, “রবির উত্তরায়ণ হইবে যখন, জানিও তখন আমি ত্যজিব জীবন...।”
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মের প্রায়োপবেশন রীতি মেনে রাজ্যপাট ছেড়ে ইচ্ছামৃত্যুর পথ নিয়েছিলেন।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যু বেছে নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত কি না, এ বার তাই নিয়ে দেশজোড়া আলোচনার আহ্বান জানাল সুপ্রিম কোর্ট। দীর্ঘ রোগশয্যায় কার্যত জীবন্মৃত রোগীর জন্য নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া যায় কি?
এই ব্যাপারেই দেশের সব ক’টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মত জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ বলেছিল, পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেই সাংবিধানিক বেঞ্চ এখন মামলা শুনছে। আজ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে নোটিস জারি করে আট সপ্তাহের মধ্যে মতামত দিতে বলেছে বেঞ্চ। বহু দেশেই ইদানীং নিষ্কৃতি-মৃত্যু আইনি বৈধতা পেয়েছে। ভারতে এ নিয়ে দীর্ঘ আইনি বিতর্ক চলছে। গত কালই সুপ্রিম কোর্টে নরেন্দ্র মোদীর সরকার নিষ্কৃতি-মৃত্যুকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, জীবন্মৃত রোগীকে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর সুযোগ দেওয়া মানে আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া। আইনের চোখে আত্মহত্যা অপরাধ। একে কখনওই আইনি বৈধতা দেওয়া চলে না। অন্য দিকে, আইন পরিবর্তন করা উচিত কি না, সে বিষয়ে সংসদই শুধু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ আজ বলেছে, সাংবিধানিক প্রশ্নের পাশাপাশি এর সঙ্গে নৈতিকতা, ধর্ম ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রশ্নও জড়িত। তাই এ ব্যাপারে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মতমতও শোনা উচিত।
এর আগে অন্ধ্রের মৃত্যুপথযাত্রী কিশোর ভেঙ্কটেশ নিজের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল। তার হয়ে আদালতে গিয়েছিলেন তার মা সুজাতা। আদালত অনুমতি দেয়নি। এর পরে মুম্বইয়ের অরুণা শানবাগ মামলায় জীবন্মৃত অরুণার জন্য নিষ্কৃতি-মৃত্যু চেয়ে আবেদন করেছিলেন বন্ধু-সাংবাদিক পিঙ্কি ভিরানি। সে বারেও অনুমতি মেলেনি। কিন্তু সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু এবং জ্ঞানসুধা মিশ্রর বেঞ্চ স্পষ্ট করে বলেছিল, নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে নির্দিষ্ট আইনি রূপরেখা তৈরি করার সময় এসেছে। বিচারপতিরা বলেছিলেন, আত্মহননের ইচ্ছাকে এক কথায় অপরাধ বলে দেগে দেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা পরিবর্তন করার সপক্ষেই মত দিয়েছিলেন তাঁরা। অর্থাৎ নিষ্কৃতি-মৃত্যু এবং আত্মহননের অধিকার সংক্রান্ত যে প্রশ্ন কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে তুলছে, সে ব্যাপারে আদালত আগেই তার মত জানিয়েছে। ২০১১ সালে অরুণা মামলার পরেও শীর্ষ আদালতকে এই মত ব্যক্ত করতে দেখা গিয়েছে।
এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে যে সওয়াল-জবাব চলছে, তার উৎসও সেই অরুণা মামলা। অরুণা মামলার রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই জনস্বার্থ মামলা করেছে ‘কমন কজ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তিন বছর আগের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রথম বার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর শ্রেণিবিভাজন করেছিল।
সরাসরি প্রাণঘাতী ওষুধ দিয়ে মৃত্যু ঘটানো বা প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি এবং কৃত্রিম শ্বাসগ্রহণ ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে পরোক্ষ নিষ্কৃতির মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করে শর্তসাপেক্ষে পরোক্ষ নিষ্কৃতির অনুমতি দিয়েছিল। শর্ত ছিল, কোনও রোগীর পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যুর ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তার মেডিক্যাল বোর্ড এবং রাজ্য সরকার ছাড়পত্র দিলে হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে তা কার্যকর করা যাবে। বর্তমানে জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীরা চাইছেন, নিষ্কৃতি-মৃত্যুর বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসা বন্ধ করে সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুগ্রহণের সিদ্ধান্তকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের দাবি, বোধশক্তি থাকাকালীনই কোনও ব্যক্তি যাতে উইল করে অন্য কাউকে তাঁর হয়ে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হোক।
উল্টো পক্ষের যুক্তি হল, কেউ মারা যাওয়ার পরেই উইল কার্যকর হয়। জীবিত অবস্থায় নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির যুক্তি, এই উইলের অপব্যবহার হতেই পারে। প্রশান্ত ভূষণ তখন যুক্তি দেন, আদালত চাইলে লিখিত ও সরকারি নথিভুক্ত উইল পেশ করার কথা বলতে পারে। কিন্তু বিচারপতি রোহিনটন নরিম্যান জানান, তাতেও অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।