পরের বার আর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারে। এক বার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর পর ভারত ভবিষ্যতে আচমকা কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারবে না পাকিস্তান।
দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মনোহর পর্রীকর পাকিস্তানকে এই কড়া বার্তাটি দিয়ে ক্ষান্ত হলে বিষয়টি অন্য রকম হত। কিন্তু সীমান্তে লড়াইয়ের থেকেও উত্তরপ্রদেশের ভোট-যুদ্ধের তাগিদ যেন আরও বড় গোটা গেরুয়া শিবিরের কাছে। তাই গোড়ায় ‘না’ ‘না’ করেও আজ শেষ পর্যন্ত সেনার বাহাদুরির কৃতিত্ব দিয়েই ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। মুম্বইয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, এই অভিযানের কৃতিত্ব পুরোদস্তুর সেনার। আর দেশের জনতার। কিন্তু এই অভিযানের পিছনে যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব যায় প্রধানমন্ত্রীর দিকে। তা নিয়ে সকলের উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী যে পুরোদস্তুর রাজনীতিই করছেন, তা আরও স্পষ্ট করলেন মনমোহন সিংহ জমানায় এ ধরনের সেনা অভিযানের কথা খণ্ডন করে। ক’দিন আগেই কংগ্রেস শিবির তাদের জমানায় করা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে বিজেপিকে টেক্কা দিতে নেমেছিল। বলেছিল, ২০১১ সালে ভারতের দুই জওয়ানের মুণ্ড কেটে নেওয়ার বদলা নিতে তিন পাকিস্তানি সেনার মুণ্ড কেটে এনেছিল আমাদের সেনারা। আর সেটিও ছিল একটি ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। ফলে এই প্রথম বার এ ধরনের সেনা অভিযান হয়েছে বলে নরেন্দ্র মোদীর ঢাক পেটানোর কোনও প্রয়োজন নেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজ বললেন, ‘‘গত দু’বছরে তিনি যা বুঝেছেন, সাম্প্রতিকতম ঘটনার আগে ভারতীয় সেনা কখনও ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেনি। সেটি ‘বর্ডার অ্যাকশন টিম’-এর কাজ হবে, যেটি আকছারই হয়ে থাকে স্থানীয় কমান্ডার স্তরে।’’
দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বলা এই কথাটি রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কংগ্রেস ফোঁস করে উঠতে তড়িঘড়ি এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বসে। দলের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘২০১১-র ঘটনা পুরোদস্তুর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছিল। কিন্তু অতীতে কখনও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়নি, এ কথা বলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কি সেই সময় নিযুক্ত সেনাবাহিনীর বাহাদুরি খাটো করতে চাইছেন? এর আগে এই প্রতিরক্ষামন্ত্রীই রাজনৈতিক কৃতিত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকতে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদী সরকারই না কি প্রথম সেনার শক্তিকে অনুধাবন করিয়েছে। আরও মিথ্যার মায়াজাল বানিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম না কি সেনা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে হামলা করেছে। আর আজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী তো শুধু সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে কৃতিত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি, অতীতে সেনার বাহাদুরিকেও খাটো করে দেখিয়েছেন।
কংগ্রেসের মতে, সেই সময়ে সেনায় যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের কেউ আজ অবসর নিয়েছেন, কেউ এখনও চাকরিরত। দেশের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সরকার। সেনার বাহাদুরি ছাপিয়ে এখন নিজেদের বাহাদুরির ঢাক পেটানো হচ্ছে নিরন্তর। বিজেপির এক নেতা অবশ্য বলেন, ‘‘কেনই বা হবে না? যখন একের পর এক সন্ত্রাস হামলা হচ্ছিল, সেই সময় এই বিরোধীরাই তো ফিতে নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ছাতির মাপ কতটা কমল, তা নিয়ে সরব হতেন। ৫৬ ইঞ্চি চুপসে ২৬ ইঞ্চি হয়ে গিয়েছে বলে তাঁরাই প্রচার করতেন। এখন নরেন্দ্র মোদী দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে তা প্রচারের দায়িত্ব বিজেপির বইকি।’’
গতকালই দশমীতে লখনউয়ে গিয়ে এক দিকে সন্ত্রাস দমনের কথা বলেও বক্তৃতার শুরু ও শেষে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি তুলেছেন। এক দিকে সেনা নিয়ে কৃতিত্ব, আর এক দিকে ‘জয় শ্রী রাম’- জাতীয়তাবাদের হাওয়ায় হিন্দু ভোটকে ফের একজোট করতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলিত, সংখ্যালঘু, গো-হত্যা বিতর্কে যেটি খসতে শুরু করেছিল। বিরোধীরা তাই এখন ঠাওর করতে পারছে না, বিজেপির এই অভিনব রণকৌশলের মোকাবিলা করা হবে কী করে? তাই কখনও মায়াবতী মোদীর রাজনীতি নিয়ে সরব হচ্ছেন। কখনও সমাজবাদী পার্টি বিরোধিতায় না গিয়ে স্রোতের অনুকূলে ভাসতে বলছে, মুলায়ম সিংহ যাদবই না কি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরামর্শ দিয়েছিলেন মোদীকে। আর ‘রক্তের দালালি’ মন্তব্য করে মোদীকে মোক্ষম জবাব দিয়ে এখন নিজেকেই ঢোক গিলতে হচ্ছে রাহুল গাঁধীকে।