চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে সুষমা স্বরাজ। ছবি: পিটিআই
কূটনীতিতে বলে সময়জ্ঞানই হল সবচেয়ে বড় জিনিস।
চিনা বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সুষমা স্বরাজের বৈঠক শেষ হওয়ার ঠিক পরেই কথাটা বলে উঠলেন চিনের এক কূটনীতিক। এর পাশে রাখা যাক ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার মন্তব্য। যিনি বলছেন, ‘‘আমাদের বিদেশনীতি? দ্রৌপদীর শাড়ির মতো! অনেক স্তর সেখানে!”
ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারত সফর সেরে যাওয়ার পরেই চিন সফরে এসেছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা। ঘোষণা করেছেন, মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও চিনে আসবেন। সময়ের জ্ঞান বা বহু স্তরের পরত, দু’ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় দিল্লির এই কূটনীতিকে।
আজ চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে বৈঠকেই সুষমা জানালেন, মোদীর সফরের কথা। সুষমার সঙ্গে এসেছেন সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশসচিব জয়শঙ্কর। চিনে এর আগে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। মান্দারিন ভাষাতেও দক্ষ। ফলে এখানকার কূটনৈতিক দৌত্যে তিনি যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। কৈলাস-যাত্রায় নাথু লা-র রাস্তা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে চিন। মে মাসে চিন ঘুরে এসে পরের মাসেই, অর্থাৎ জুনে মোদী নিজে এই নতুন রাস্তা ধরে কৈলাস দর্শনে যাবেন বলে ঠিক হয়েছে। সীমান্ত উত্তেজনা দ্রুত কমানোর ব্যাপারেও দ্বিপাক্ষিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদী চিনের মাটিতে পা রাখার আগে এই ভাবেই জমি তৈরির কাজটা সেরে রাখছেন সুষমা।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-ঘাটতি মেরামত করাকে যে পাখির চোখ করছেন মোদী, সেটাও আজ চিনকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন সুষমা। বলেছেন, “ভারতের বাজারে চিনের ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের সংস্থাগুলির ব্যবসাও যাতে চিনদেশে একই ভাবে বাড়ে, সেটাও দেখতে হবে।” ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন সফল করতে ভারতের দু’টি রাজ্যে শিল্প-পার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে চিন ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করতে রাজি হয়ে গিয়েছে। কাল চিন-ভারত-রাশিয়ার বৈঠক হবে। রাশিয়াকে ডাকাটা চিনের তরফে একটা ‘প্যাঁচ’ বলে অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু তাতে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অবশ্য চিন নিয়ে খুবই আক্রমণাত্মক ছিলেন মোদী। অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে তাঁর কড়া মন্তব্য শুনে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও চিন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা বেড়েছে বই কমেনি। লাদাখে চিনা অনুপ্রবেশের অভিযোগ ওঠায় ভারতীয় সাংবাদিকদের বেজিং সফর বাতিল করে দেন তিনি। ক্ষমতায় এসে সবার আগে জাপান সফরে যান গত সেপ্টেম্বরে। তাতেও চিনের রক্তচাপ বাড়ে। অতঃপর সেপ্টেম্বরেই চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর ভারত সফর। আমদাবাদে সাবরমতীর তীরে দুই রাষ্ট্রনায়ক দোলনায় দুললেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কি পাল্টাল? দিল্লিতে হিন্দিভাষীরা যাকে বলেন ‘জমিনি হকিকৎ’, তাতে কি কোনও বদল হলো?
চিন-পাকিস্তান অক্ষের সক্রিয়তা কিন্তু বেড়েছে। চিনের কর্তারা ঘনঘন মায়ানমারও যাচ্ছেন। ওবামা-মোদীর বৈঠক নিয়েও চিনের প্রতিক্রিয়া খুবই তীব্র। চিন তাদের সরকারি মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের মতে ওবামা-মোদীর শরীরী ভাষা যতই বন্ধুত্বপূর্ণ হোক না কেন, আসলে এই সখ্য কৃত্রিম। এটা বাইরের চেহারা, সত্য নয়। এই আবহে প্রথমে সুষমাকে পাঠিয়ে তার পর নিজে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মোদী। ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চিন প্রসঙ্গে খানিকটা সময় নিয়ে হিসেব কষে চলাই মোদীর লক্ষ্য। তাই ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম দফায় ইচ্ছে করেই তিনি চিন নিয়ে মাতামাতি করেননি। বরং নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেছেন (পরে দু’দেশের সম্পর্কে ফের দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে)! নেপাল-ভুটান সফর করেছেন। বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন বিদেশমন্ত্রীকে।
আর বৃহৎ শক্তির মধ্যে মোদী প্রথম পর্বে জাপান আর আমেরিকা এই দু’টি দেশের সঙ্গে জটিলতার নিরসন করেছেন। মোদীর সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র সম্পর্ক বরাবরই মধুর। মোদী নিজেই এই প্রতিবেদককে বলেছেন, সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীই তাঁর সঙ্গে শিনজোর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। যখন মোদী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, ভাইব্র্যান্ট গুজরাতেও এসেছেন শিনজো। ফলে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করাটা মোদীর পক্ষে খুব কঠিন হয়নি।
আর এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবসে ওবামাকে ভারতে ডেকে কূটনীতির যে নতুন পর্ব মোদী শুরু করতে চাইছিলেন, তা-ও সফল হয়েছে। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির বাস্তবায়ন চূড়ান্ত হয়েছে। এ বার মোদী দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করবেন। তাই তিনি সুষমাকে চিনে পাঠিয়ে সম্পর্কের তাপমাত্রা কমাতে তৎপর।
কিন্তু ঘটনা হল, শিনজো-মোদীর সম্পর্ক দেখে মার্কিন কর্তারা খুশি হয়ে থাকতে পারেন। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, এমনকী দক্ষিণ কোরিয়াও খুশি হতে পারে। কিন্তু চিন? ভারত-বিরোধিতার তাসকে তারা তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। পাশাপাশি ঘরের মাটিতে আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের চিন বিরোধিতাও বেশ কড়া রকমের। মোদী নিজে তা হলে কী চাইছেন? কূটনৈতিক সূত্র বলছে, মোদী চিনের সঙ্গে সংঘাতেই যেতে চান, এমন নয়। মোদীকে যখন আমেরিকা ভিসা দেবে না বলে আগাম হুমকি দিয়েছিল, তখন চিনই তাঁকে বেজিং-এ নিয়ে যায় সসম্মানে। তা ছাড়া, আমেরিকা ও চিনের যতই সংঘাত থাক, ভারত-চিন উভয়েই উভয়ের উপরে অত্যন্ত নির্ভরশীল। এই সত্য কোনও ভাবে বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই। তাই বাস্তবের রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়াই মোদীর লক্ষ্য।
তবে তার মানে এই নয় যে, ভারত চিনের সামনে নতজানুু হয়ে বলবে, ‘হে ড্রাগন, তোমার নিঃশ্বাসের কাছে আমার বিশাল হাতিও পরাস্ত’। তাই দ্রৌপদীর শাড়ির মতো বিদেশনীতিতে বহু স্তর। প্রণব মুখোপাধ্যায় বহু দিন আগে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, মহাজনের কাছে টাকা ধার নিতে গেলেও হাতে হীরের আংটি পরে যেতে হয়। সেটাই করছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। মনমোহন সিংহ যখন চিনে গিয়েছিলেন, তখন তিনিও বলেছিলেন, “ভারতীয় বাজারে তুমি ডাম্পিং করবে, পুতুল থেকে চকোলেট সব রফতানি করবে, অথচ ভারতের পণ্য চিনের বাজারে ঢুকতে দেবে না এমনটা চলবে না।” কিন্তু তখন মনমোহন সরকার ছিল ঘরে-বাইরে দুর্বল। আজকের মোদী সরকার ২৮১টি আসন নিয়ে স্ববলে বলীয়ান।
ভারত-চিন সম্পর্কে জটিলতা আছে, নিরাপত্তার অভাব আছে। কিন্তু কূটনীতি কখনওই সম্পর্ককে এমন চরম বিন্দুতে নিয়ে যেতে চায় না, যেখানে ফেরার রাস্তা থাকবে না। যে ভাবে একদা চিনা বরফ গলিয়েছিলেন রাজীব গাঁধী, যে যুক্তিতে চিন সফর করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেই মনোভাব নিয়েই চিন যাবেন মোদী। কূটনীতিকরা একে বলে থাকেন, ‘এনগেজমেন্ট’। কারণ, দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষ জরুরি। জরুরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। মোদী সে কথা সম্যক জানেন।