‘ফোন এলে আর সালাম আলেকুম বলি না’

ক’দিন বাদেই অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার রায়। এই সন্ধিক্ষণে কী ভাবছেন উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘুরা?

Advertisement

অগ্নি রায়

আলিগড় শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:৩৫
Share:

ক্যান্টিনে সব্বির মিয়াঁ। নিজস্ব চিত্র

‘হম বুলবুলে হ্যায় ইসকি, ইয়ে গুলিস্তাঁ হমারা!’

Advertisement

এই লাইনের বাইরে আর যেতে চাইছেন না সব্বির ভাই! আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের বিখ্যাত ফলের রসের স্টলটি যত প্রাচীন, এ চত্বরে সব্বির মিয়াঁর মেয়াদও প্রায় তত দিনই। কলকাতার কাগজ থেকে এসেছি শুনে খানদানি কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে বিটনুন দেওয়া আনারসের শরবত হাতে ধরিয়ে দিলেন। দাবি করলেন, ছাত্রাবস্থায় মজিদ, জামশিদকেও এই রস খাওয়াতেন! কিন্তু বাতাসের হালচাল কেমন বুঝছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে বারবার ‘সারে জঁহা সে আচ্ছা’-র কয়েকটি লাইনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর মুখে।

গত ফেব্রুয়ারিতে এই শতাব্দী প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘জঙ্গিদের আখড়া’ বলে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন আগরার মেয়র। তার আগেই এখানকার লাইব্রেরিতে জিন্নার ছবি নিয়ে প্রবল বিতর্ক এবং তদন্তের প্রক্রিয়া চলেছে। এখানে পৌঁছে হাজার একরেরও বেশি ক্যাম্পাসের বাতাস শুঁকেই বোঝা যাচ্ছে, ক্ষোভের বারুদ রয়েছে এবং সব্বির মিয়াঁ ঝামেলা এড়াতে চাইছেন। “বেশি কপচে কী লাভ বলুন! আবার বিতর্ক তৈরি হবে। কোনও কিছুর প্রতিবাদ করলে আমরা দেশদ্রোহী হয়ে যাব। লাভ হবে হিন্দুত্ববাদীদের। দেশের অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা থেকে নজর সরিয়ে দেওয়া আরও সহজ হবে।”— নাম গোপন রাখার শর্তে বললেন, গত বছরের ইউনিয়নের (এ বছর ভোট স্থগিত রয়েছে) এক শীর্ষ ছাত্র নেতা। “ক্যাম্পাস ঘুরে দেখুন, কেউ দিল খুলে কথা বলছে না। আগে আমরা কারও মতামত অপছন্দ হলে মুখের উপর বলতাম। সে হিন্দু, না বৌদ্ধ, না মুসলমান, না শিখ ভাবতাম না। এখন ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে,” বললেন তাঁর পাশে দাঁড়ানো আর এক সংখ্যালঘু ছাত্রনেতা।

Advertisement

তবে ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, গুঞ্জন এবং স্পষ্ট মূল্যায়নেরও অভাব নেই। মাস কমিউনিকেশনের বিভাগীয় প্রধান শাফে কিদোয়াই যে কোনও বিতর্কে প্রতিষ্ঠানের মুখ হিসেবে নিরপেক্ষ মতামত দিয়ে এসেছেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পরামর্শও দিলেন, “অপেক্ষাকৃত নতুন ছাত্রদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলুন। ওদের মন জানতে পারবেন। বৃহৎ চিত্রটাও পাবেন, কারণ এখানে গোটা দেশের তো বটেই, বিদেশি ছাত্রদেরও সমান আনাগোনা।” আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন কিদোয়াই। “গত সত্তর বছর ধরে এ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা কারণে বিভ্রম ও আতঙ্কের একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল— এই বোধ হয় আমরা আক্রান্ত, নিপীড়িত হচ্ছি! তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মানসিকতা কমে আসছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে আবার যে কে সেই!

ও দিকে হিন্দুত্বের জোয়ার যত বেড়েছে, এ দিকে আইডেন্টিটি পলিটিক্সও বেড়ে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে যদি আসতেন, এত হিজাব পরা ছাত্রী দেখতে পেতেন না। এখন বোরখা পরার জন্য সামাজিক চাপ বেড়ে গিয়েছে প্রবল ভাবে।”

তাঁর এই মন্তব্যের সারবত্তা মিলল মাস কমিউনিকেশন বা সমাজ বিজ্ঞানের অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রদের রাগী বক্তব্যে। প্রথম বর্ষের আনিসুর কলিমুল্লার কথায়, “এ দেশে এখন গরুর অধিকার রয়েছে, কিন্তু মানুষের নেই। এটা মনে রাখতে হবে আমরা গাঁধী-নেহরুর সময়ে বাস করি না। এখন নিজেদের পরিচয়কে একজোট করে রাজনীতি ও ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে পারলে তবেই মূল রাজনৈতিক স্রোতে দরকষাকষির জায়গা তৈরি হবে। সবাই তো সেটাই করছে। অখিলেশ-মুলায়ম যাদবদের নিয়ে, মায়াবতী দলিতদের নিয়ে, বিজেপি সামগ্রিক হিন্দুদের নিয়ে।”

ইলাহাবাদ থেকে আসা মহম্মদ ইউনুস ক্যান্টিনে বসে শোনাচ্ছিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। “যখন স্লিপার ক্লাসে যাতায়াত করি, ফোন এলে তুলেই সালাম আলেকুম বলি না। হ্যালো বলে কথা শুরু করি। ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ!” তাঁর কথায়, “গাঁধীর রামধুনে তো কেউ ভয় পেত না। এখনকার জয় শ্রীরাম ধ্বনি তো একেবারেই আলাদা।”

রামমন্দির প্রসঙ্গে সব্বির মিয়াঁর মতনই নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছেন এখানকার সংখ্যালঘু ছাত্ররা। এক জন নাম গোপন রাখার শর্তে বললেন, “বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার কী হল? সাতাশ বছর হয়ে গেল। দোষীরা কবে শাস্তি পাবে?” মুজফ্‌ফরনগরের মাছি ভনভন এলাকায় যা দেখেছিলাম, দেশের অন্যতম প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়েও তার অন্যথা দেখলাম না। তা হল, রামমন্দির মামলার রায় যা-ই হোক না কেন, তা নিয়ে যেন কোনও প্রতিক্রিয়া না দেওয়া হয়— সংখ্যালঘু ছাত্রদের সর্বস্তরে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নিয়ম করে। নতুন করে যেন কোনও অশান্তি না তৈরি হয়।

‘সারে জঁহা সে অচ্ছা’-র আড়ালেই আপাতত লুকোতে ব্যস্ত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন