পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ লাদাখে। ছবি: পিটিআই।
মাঝে চার মাসের বিরতির পর আগামী ৬ অক্টোবর আলোচনায় বসার কথা কেন্দ্র ও লেহ অ্যাপেক্স বডির। অথচ, তার মাত্র দিন কয়েক আগেই অশান্ত হয়ে উঠেছে লাদাখ। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বুধবারের বিক্ষোভে প্রাণ গিয়েছে চার জনের। নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে জখম অন্তত ৮০ জন। এই ঘটনার পর বুধবারই ৩৫ দিনের অনশন ভেঙেছেন জলবায়ু কর্মী সোনম ওয়াংচুক। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জারি হয়েছে কার্ফু। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে চার জনের বেশি লোকের জমায়েত নিষিদ্ধ হয়েছে এলাকা জুড়ে। কিন্তু কী ভাবে দানা বাঁধল আন্দোলন? কেন বৈঠকের ঠিক আগে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করল ক্ষুব্ধ জনতা?
প্রেক্ষাপট
লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি এই প্রথম নয়। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং সাবেক রাজ্য ভাগের পরে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল লাদাখ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার দাবি দানা বাঁধছে উত্তর ভারতের এই প্রান্তিক অঞ্চলে। গত কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলনও চলছে। জলবায়ু কর্মী সোনম এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ। তাঁর বক্তব্য, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক। পাশাপাশি, লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন, লেহ এবং কার্গিল জেলার জন্য পৃথক লোকসভা আসন— এমনই নানা দাবি নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন বাস্তবের ‘র্যাঞ্চো’। অতীতে বেশ কয়েক বার অনশনেও বসেছেন তিনি। গত বছরের মার্চ মাসে ২১ দিন অনশন করেছিলেন সোনম। ওই বছরেরই অক্টোবরে দিল্লির লাদাখ ভবনের সামনে ফের অনশনে বসেন তিনি। সেখান থেকে তাঁকে থানাতেও তুলে নিয়ে যায় দিল্লি পুলিশ। কিন্তু তাতে দমেননি সোনমেরা। শেষমেশ কেন্দ্রের তরফে লাদাখের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি মেলার পর তিনি অনশন ভাঙেন।
কী ভাবে অশান্তি শুরু লাদাখে
এর পর চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে ফের অনশন শুরু করেন সোনম। যদিও ওই সময়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি (এইচপিসি), এইচপিসি-র সাব কমিটি এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা চলছিল কেন্দ্রের। লেহ অ্যাপেক্স বডি এবং কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল ভারত সরকার। কেন্দ্রের দাবি, ইতিমধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। যেমন, লাদাখে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ ৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করা হয়েছে। কাউন্সিলের মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। ভোটি এবং পুর্গিকে সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে, ১,৮০০টি শূন্যপদে নিয়োগও শুরু হয়ে গিয়েছে। ৬ অক্টোবর আর একটি এইচপিসি সভার দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। ২৫ এবং ২৬ সেপ্টেম্বর লাদাখের নেতাদের সঙ্গেও অতিরিক্ত সভা করার কথা ছিল কেন্দ্রের। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, এই পদক্ষেপগুলি সত্ত্বেও নাকি কিছু ব্যক্তি ‘রাজনৈতিক কারণে’ এইচপিসি-র অগ্রগতিতে অসন্তুষ্ট। তাঁরা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে’ গোটা আলোচনা বানচাল করার চেষ্টা করছেন। সে কারণেই ৬ অক্টোবরের বৈঠকের ঠিক আগে এ ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে লাদাখে।
সোনমকে দুষছে কেন্দ্র
কেন্দ্রের দাবি, সোনমের দাবিগুলি এইচপিসি-র অ্যাজেন্ডার অংশ। সে কথা সোনমও জানেন। অথচ নেতাদের বার বার অনুরোধের পরেও তিনি অনশন ভাঙতে রাজি হননি। কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে, ‘‘লাদাখের জনগণকে ‘আরব বসন্ত’ কিংবা নেপালের ‘জেন জ়ি’-র প্রসঙ্গ তুলে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই জনতার একটি অংশ অনশনস্থল ছেড়ে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ও সরকারি দফতরে হামলা চালিয়েছে।’’ যদিও বুধবারের বিক্ষোভ নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন সোনম নিজেও। স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনও সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করেন না তিনি। সোনম বলেন, ‘‘এটি লাদাখের জন্য তো বটেই, ব্যক্তিগত ভাবে আমার জন্যও সবচেয়ে দুঃখের দিন! কারণ, গত পাঁচ বছর ধরে আমরা যে পথে হাঁটছি, তা ছিল শান্তিপূর্ণ। আমরা পাঁচ বার অনশন করেছি, লেহ থেকে দিল্লি পর্যন্ত হেঁটেছি। কিন্তু আজ এই হিংসা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আমাদের শান্তির বার্তা ব্যর্থ হতে দেখলাম।’’ বুধবারই অনশন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেছেন তিনি।
বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, চার মৃত্যু
বুধবার সকাল থেকে ফের বিক্ষোভ শুরু হয় লেহতে। বিজেপি-র দফতরে আগুন লাগিয়ে দেন একদল বিক্ষোভকারী। নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চার জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৮০ জন, যার মধ্যে অন্তত জনাকুড়ি নিরাপত্তারক্ষীও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সোনম ওয়াংচুকের ‘উস্কানিমূলক বক্তৃতা’য় উদ্বুদ্ধ হয়ে একদল যুবক অনশনস্থল ছেড়ে একটি রাজনৈতিক দলের দফতরের দিকে এগিয়ে যান। তার পর সেখানে আগুন লাগিয়ে দেন তাঁরা। লেহর সিইসি-র (মুখ্য নির্বাচনী কর্তা) সরকারি দফতরেও হামলা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী। কেন্দ্রের দাবি, নিরাপত্তাবাহিনীর উপরেও চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। এতে পুলিশের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ এবং সিআরপিএফ সদস্য। শেষমেশ আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি চালালে তাতে মৃত্যু হয় চার জনের। বিকেল ৪টের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আপাতত এলাকায় কার্ফু চলছে। সকলকে সমাজমাধ্যমে পুরনো এবং উস্কানিমূলক ভিডিয়ো প্রচার করা থেকেও বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।