সইসাবুদে সমূহ সঙ্কট

মামলার গেরোয় স্মৃতি, বিপাকে পঙ্কজাও

দুপুর তখন আন্দাজ ৩টে। সদ্য শেষ হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। সাংবাদিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ঘোষণা করছেন, ‘‘এটা ইউপিএ সরকার নয়, এনডিএ সরকার। এনডিএ সরকারের মন্ত্রীরা ইস্তফা দেন না।’’ পাশ থেকে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে যোগ করছেন, ‘‘এই সরকার ইউপিএ-র মতো কুকীর্তিও করে না।’’ দুই মন্ত্রী চরম আত্মবিশ্বাসী মুখ দেখালেও দলের অন্দরে তত ক্ষণে বইতে শুরু করেছে নয়া অস্বস্তির চোরা স্রোত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

দুপুর তখন আন্দাজ ৩টে। সদ্য শেষ হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। সাংবাদিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ঘোষণা করছেন, ‘‘এটা ইউপিএ সরকার নয়, এনডিএ সরকার। এনডিএ সরকারের মন্ত্রীরা ইস্তফা দেন না।’’ পাশ থেকে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে যোগ করছেন, ‘‘এই সরকার ইউপিএ-র মতো কুকীর্তিও করে না।’’

Advertisement

দুই মন্ত্রী চরম আত্মবিশ্বাসী মুখ দেখালেও দলের অন্দরে তত ক্ষণে বইতে শুরু করেছে নয়া অস্বস্তির চোরা স্রোত।

ছিলেন দু’জন— সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজে। এলেন আরও দুই— কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং মহারাষ্ট্রের মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী তথা প্রয়াত বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুণ্ডের মেয়ে পঙ্কজা মুণ্ডে! নির্বাচন কমিশনে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভুয়ো তথ্য দেওয়ার অভিযোগে স্মৃতির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি আজ শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে আদালত। আর পঙ্কজার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কোনও দরপত্র ছাড়া একই দিনে ২৪টি সংস্থাকে শিশুদের স্কুলের জন্য ২০৬ কোটি টাকার জিনিসপত্র কেনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই স্মৃতি-পঙ্কজার খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। দলের একের পর এক মন্ত্রীর নামে উঠে আসছে অভিযোগ— তাঁরা ইস্তফা দেবেন কি না, প্রশ্নটা রাখা হয়েছিল রাজনাথের কাছে। যার উত্তরে ইউপিএ জমানাকে খোঁচা দেন তিনি। তখনও বিজেপি নেতারা জানেন না, সন্ধের পরে বিরোধীদের পাতে তৃতীয় মিষ্টিটাও পড়ে যাবে। ললিত মোদীকে ব্রিটেনে অভিবাসন পাইয়ে দিতে বসুন্ধরা রাজের সই-সহ নথি প্রকাশ করবেন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ।

ফলে সন্ধের পর থেকে আলোচনাটা দাঁড়িয়েছে, ‘কে আগে যাবেন?’ জয়রাম রমেশ বলে দিয়েছেন, ‘‘তিন জনের ইস্তফার দাবি নিয়ে কংগ্রেস কোনও রকম আপস করবে না। এক এক করে সকলকে ইস্তফা দিতে হবে। একেবারে টিভি সিরিয়ালের মতো। আজকের পর বসুন্ধরার ইস্তফার দাবি থাকল পয়লা নম্বরে। দু’নম্বরে থাকলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিন নম্বরে স্মৃতি ইরানি।’’ আর পঙ্কজা? জয়রাম জানান, ওই ব্যাপারে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় শোরগোল তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বকে।

অভিযোগের ধার ও ভার বিচার করলে পঙ্কজার চেয়ে স্মৃতির চাপটা সামান্য হলেও বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধেই উঠেছে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে উপর্যুপরি ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে স্মৃতি শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। পরে আহমের খান নামে এক ব্যক্তি আদালতে অভিযোগ করেন, ২০০৪-এর রাজ্যসভা এবং ২০১৪-র লোকসভা ভোটের সময়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য পেশ করেছেন স্মৃতি। আহমেরের দাবি, ২০০৪-এর হলফনামায় স্মৃতি জানান, তিনি বিএ পাস। আবার লোকসভা ভোটের সময়ে হলফনামায় স্মৃতি লেখেন, তিনি বি-কম প্রথম বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

আহমেরের এই মামলাটিই আজ গ্রহণ করেছেন দিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্টের মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট আকাশ জৈন। আগামী ২৮ অগস্ট সমস্ত তথ্যপ্রমাণ তলব করেছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবে কংগ্রেস তো বটেই, আম আদমি পার্টিও স্মৃতির ইস্তফার দাবি তুলেছে। ক’দিন আগেই ভুয়ো ডিগ্রির অভিযোগে আপের মন্ত্রী জিতেন্দ্র তোমরকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে কেন্দ্রের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ। আজ আপ নেতা আশুতোষের কটাক্ষ, ‘‘আশা করছি, যে দ্রুততার সঙ্গে জিতেন্দ্র তোমরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই দ্রুততায় স্মৃতিকেও গ্রেফতার করা হবে। বা প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত করবেন। দেশের শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ভুয়ো— এর থেকে খারাপ কী হতে পারে!’’ সাংবাদিক বৈঠকে বিজেপি মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র দাবি করেন, তোমরের সঙ্গে স্মৃতির তুলনা টানা ঠিক নয়। তাঁর যুক্তি, ‘‘ওটা (স্মৃতির ভুল তথ্য দেওয়া) টাইপোগ্রাফিক্যাল ভুল। সনিয়া গাঁধীর ক্ষেত্রেও হয়েছিল।’’


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন

এ দিকে, পঙ্কজার পাশে দাঁড়িয়েছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। বলেছেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, কোনও অনিয়ম হয়নি। দরকারে তদন্ত হবে। পঙ্কজাও তদন্তের মুখোমুখি হতে রাজি।’’ মহারাষ্ট্রে মাত্র ছ’মাস আগে সরকার গড়েছে বিজেপি। এর মধ্যেই তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি পঙ্কজার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সরকারি নিয়ম ভেঙেই ২৪টি সংস্থাকে ২০৬ কোটি টাকার জিনিসপত্র কেনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মূলত সরকার পরিচালিত বিভিন্ন আদিবাসী স্কুলের জন্য বই, মাদুর ও ‘চিকি’ (বাদাম-চাকতি)-র মতো খাবার কিনতে ওই টাকা মঞ্জুর করেন তিনি। কিন্তু মহারাষ্ট্রের আইন বলছে, সরকারি টাকায় তিন লক্ষ বা তার বেশি টাকার কেনাকাটা করতে হলে অবশ্যই ই-টেন্ডার ডাকতে হবে। পঙ্কজার যুক্তি, দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে লাল ফিতের ফাঁস এড়াতেই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এমবিএ ডিগ্রিধারী, আগাগোড়া রাজনীতির পরিবারের মেয়ে (তিনি প্রয়াত বিজেপি নেতা প্রমোদ মহাজনের ভাগ্নিও) পঙ্কজার এই যুক্তি মানতে রাজি নন অনেকেই।

মোটের ওপর পরিস্থিতি যা, তাতে সংসদের বাদল অধিবেশনের আগে অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছে নরেন্দ্র মোদীর। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, ললিত মোদী বিতর্কের সঙ্গে এ বার পঙ্কজা ও স্মৃতির বিষয়টি জুড়ে যাওয়ায় উত্তাল হবে সংসদ। আরও এক বার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে জমি বিল, জিএসটি-সহ সংস্কারমুখী বিভিন্ন বিলের ভবিষ্যৎ। লাভের মধ্যে, বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর দলের অন্দরে যে বিরোধী স্বরগুলি চাপা পড়ে গিয়েছিল, তার লাগাতার প্রকাশ অব্যাহত। লালকৃষ্ণ আডবাণী ক’দিন আগে বলেছিলেন, ‘দেশে জরুরি অবস্থা আবার ফিরতে পারে।’ আজ মোদী সরকারকে খোঁচা দিয়েছেন দলের প্রবীণ নেতা, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারে আডবাণীর সতীর্থ যশবন্ত সিন্‌হাও। ‘‘দলে যাঁদের বয়স পঁচাত্তরের বেশি, ২০১৪-র ২৬ মে-র পর তাঁদের ‘ব্রেন ডেথ’ হয়ে গিয়েছে’’— আজ বলেছেন তিনি। ওই তারিখেই শপথ নেন মোদী। দলে বৃদ্ধতন্ত্রের অবসান ঘটানোর যে প্রয়াস তিনি গোড়া থেকেই চালাচ্ছিলেন, আজ তাকেই এক হাত নিলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত। সারা দিনে কোনও প্রসঙ্গেই মুখ খোলেননি মোদী। দলে তাঁর রাশ আলগা হওয়ার অস্বস্তিকর জল্পনাটা দিনের শেষে তাই আবার মাথাচাড়া দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন