সঙ্গী রামগোপাল, টিপু ঝড়ে গদি টলমল মুলায়মের

নাটকের দ্রুত পটপরিবর্তনে বোধহয় মহাভারতকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশে যাদববংশের বর্তমান মুষলপর্ব! শুক্রবার সন্ধ্যায় বড় ছেলে ‘টিপু’ তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশকে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৫৭
Share:

কর্মসমিতির বৈঠক শেষে অখিলেশ ও রামগোপাল। রবিবার লখনউয়ে। ছবি: পিটিআই

নাটকের দ্রুত পটপরিবর্তনে বোধহয় মহাভারতকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশে যাদববংশের বর্তমান মুষলপর্ব!

Advertisement

শুক্রবার সন্ধ্যায় বড় ছেলে ‘টিপু’ তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশকে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব। সঙ্গে নিজের তুতো-ভাই, অখিলেশপন্থী রামগোপাল যাদবকেও। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, শনিবার দুপুরেই ডিগবাজি খেয়ে ছেলে এবং ভাইকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। রাত পোহাতেই, ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন সকালে যাদব-যুদ্ধে নয়া মোড়! রামগোপালের কৌশলে এবং দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ-বিধায়কের সমর্থন নিয়ে সমাজবাদী পার্টির নয়া সভাপতি নির্বাচিত হলেন টিপু। ছেলের কাছে সভাপতি পদ খোয়ালেন দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম। পাল্টা আঘাতে দুপুরেই রামগোপালকে ফের দল থেকে তাড়িয়ে নেতাজি জানিয়ে দিলেন, কর্মসমিতির ওই বৈঠকই অবৈধ! বৃহস্পতিবার ফের বৈঠক হবে।

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার বিকেল। পুরো ৭২ ঘণ্টাও কাটেনি। একের পর এক নাটকের ধাক্কায় সপা-র নেতা-কর্মীরা চূড়ান্ত বিভ্রান্ত! সামনেই উত্তরপ্রদেশে ভোট। এই মুহূর্তে সপা-র প্রধান কে? নেতাজি না টিপু? এটা স্পষ্ট, টিপুর জনপ্রিয়তার ঝড়ে মুলায়মের আসন টলেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীই টিপুর পাশে। এমনকী মুলায়ম-ঘনিষ্ঠরাও অখিলেশের দিকে সরে গিয়েছেন। কিন্তু নেতাজি তো আবার ওই বৈঠককে অসাংবিধানিক বলেছেন! তা হলে? পুরোটাই ধোঁয়াশা।

Advertisement

এর পরে কী হবে? এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলে। এবং সকলেই এক কথায় বলছেন, কী হবে কেউ জানে না! জানেন শুধু নেতাজি! গত কাল বলা হচ্ছিল অখিলেশ-বিতাড়ন পুরোটাই নাটক এবং সেটা নেতাজির মস্তিষ্কপ্রসূত। রাজনীতির আখড়ায় প্রাক্তন কুস্তিগীর মুলায়মের ডিগবাজির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু আজকের ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠছে, এটাও কি মুলায়মের চিত্রনাট্য মেনে হচ্ছে? নাকি ঘটনার উপর তাঁর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই? শেষ পর্যন্ত সপা-র ভাঙনই নিয়তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে? কারণ রাতেই অখিলেশ সমর্থকেরা সপা-র সদর দফতরের দখল নিয়েছেন। এমনকী দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘সাইকেল’-এর দাবি নিয়েও তাঁরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে সময় চেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে দু’পক্ষে আইনি লড়াইয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

কী হয়েছে এ দিন?

রবিবার সকালে সপা-র জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক ডেকেছিলেন সদ্য ঘরে ফেরা রামগোপাল। সেখানে নিজের সমর্থক সাংসদ-বিধায়কদের শক্তিতে বলীয়ান (অবশ্যই তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, দু’শোরও বেশি) ‘টিপু’ দলের সভাপতি হলেন মুলায়মকে সরিয়ে। একই সঙ্গে সপা-র উত্তরপ্রদেশের সভাপতি পদ থেকে সরালেন ‘কাকা’ শিবপাল যাদবকে। তাড়ানো হল অখিলেশ শিবিরের ‘কাঁটা’ অমর সিংহকেও। অখিলেশকে দলের নতুন প্রধান বলে ঘোষণা করে রামগোপাল যাদবের সংযোজন, ‘‘নেতাজির উচিত দলের চিফ মেন্টর বা ‘মার্গদর্শক’ হিসেবে সঙ্গে থাকা।’’

নাটকের দ্বিতীয় পর্বের শুরু এর পরেই। সকালেই মুলায়ম হুঙ্কার ছেড়েছিলেন অখিলেশের ডাকা এই কর্মসমিতির বৈঠক ‘অবৈধ’ এবং ‘দলবিরোধী’। দলের নেতা, কর্মীদের এই বৈঠকে না আসার জন্য সতর্কও করেছিলেন তিনি। কিন্তু নেতাজির নির্দেশ উপেক্ষা করেই বৈঠকে আসেন সিংহ ভাগ নেতা-কর্মী-সাংসদ, বিধায়ক। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, সপা-য় অখিলেশের নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে অনেক বেশি। আর বসে থাকেননি নেতাজি। বেলার দিকে রামগোপালকে ফের বহিষ্কার করলেন তিনি। একই সঙ্গে দলের কর্মসমিতির সদস্যদের চিঠি দিয়ে আজকের বৈঠককে ‘অসাংবিধানিক’ ও ‘বেআইনি’ উল্লেখ করেন। জানিয়ে দেন, ৫ জানুয়ারি ফের বসবে কর্মসমিতির বৈঠক। মুলায়মের দাবি, রবিবারের কর্মসমিতির বৈঠক দলের সভাপতির (অর্থাৎ তাঁর) অনুমতি নিয়ে ডাকা হয়নি। ফলে এখানে নেওয়া কোনও সিদ্ধান্তই বৈধ নয়।

মুলায়ম-ঘনিষ্ঠ একাংশ গত কাল বলেছিলেন, সপা-র অন্দরে অখিলেশের ভিত আরও মজবুত করার জন্যই তাঁকে বহিষ্কারের নাটক করেছিলেন মুলায়ম। নাটকের প্রথম অঙ্কে দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা (যাঁকে সপা-কর্মীরা কৈকেয়ী বলে ডাকেন!), অমর সিংহ এবং নিজের ছোটভাই শিবপালের চাপে বড় ছেলে টিপুকে দল থেকে তাড়িয়ে মাথা নোয়ানোর ভঙ্গি করেছিলেন কৌশলী নেতাজি। দ্বিতীয় অঙ্কে সেই সিদ্ধান্ত ঘিরে দলের কর্মীদের ক্ষোভের চেহারা দেখিয়ে দিলেন এই ত্রয়ীকে (অমর-শিবপাল-সাধনা)। বোঝালেন, অখিলেশ এতটাই জনপ্রিয় যে তাঁকে না ফেরালে দল ভাঙবে এবং ক্ষমতায় আসবে বিজেপি বা মায়াবতীর বসপা। তাতে আম-ছালা দুই-ই যাবে। সুতরাং ২৪ ঘণ্টা পেরনোর আগেই টিপুর ঘরে ফেরা। সঙ্গে রামগোপালেরও। এবং সেই ঘোষণাও টিপুর চরম-বিরোধী শিবপালকে দিয়ে! সোজা আঙুলে এটা করা কঠিন ছিল বলেই নেতাজি আঙুল বেঁকিয়েছিলেন বলে দাবি ছিল মুলায়ম-ঘনিষ্ঠদের। কিন্তু আজকের ঘটনা সব হিসেবই উল্টে দিল।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, অখিলেশ কি নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ঝটিতি পদক্ষেপে বাবা-কাকাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন? রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, এটা করা ছাড়া অখিলেশের উপায়ও ছিল না। তিনি ঘরে ফিরলেও নিষ্কণ্টক হননি। শিবপাল বা অমর সিংহ দলীয় পদে থেকে গেলে যে তাঁর প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়া কঠিন, তা বিলক্ষণ জানেন টিপু। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ার পথে বাধা তৈরি করবে শিবপাল-পক্ষ। মুলায়মকে ফের হাত করে নিজেদের লোককে টিকিট দেওয়ার চেষ্টাও চলবে।

তাই অঙ্ক কষে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়েই আজ এগিয়েছিলেন অখিলেশ। মাথায় রেখেছিলেন মুলায়ম-তাসও। কর্মসমিতির বৈঠকে ‘জয় অখিলেশ’ ধ্বনির মধ্যেই তিনি বলেন, “যদি কেউ নেতাজির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তবে আমার দায়িত্ব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।” পাশাপাশি অখিলেশ-শিবিরের তরফে এ কথাও বলা হয়েছে, মুলায়মকে টিপু ঘরোয়া ভাবে জানিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে দল ক্ষমতায় ফিরলে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাট মুলায়মের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু যারা বাবা-ছেলের বিভাজন তৈরি করে উত্তরপ্রদেশে সপা-কে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করছে, তাদের কোনও ভাবেই ছাড়া হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন