দিল্লির আরামবাগের মণ্ডপ।—নিজস্ব চিত্র।
প্রতিমা থেকে প্যান্ডেলের সাজগোজ— সবই তৈরি হয়েছিল পাট দিয়ে। যমুনার পাড়ে আরামবাগের পুজোয় উঠে এসেছিল এক চিলতে গঙ্গাপারের ছবি। তবে শেষ রক্ষা হল কোথায়? চার দিনের আলোর রোশনাইয়ের মধ্যেও দিল্লির পাটের-পুজো মণ্ডপে নেমে এল অন্ধকার!
খবর এসেছে, অষ্টমীর দিনই তালা পড়ে গিয়েছে হুগলির গোন্দলপাড়া চটকলে। রুজি বন্ধ আরও কিছু মানুষের। অন্ধকার আরও কিছু পরিবারে। বাংলার পাটশিল্প যে মুখ থুবড়ে পড়ছে ভালই জানেন আরামবাগের পুজো উদ্যোক্তারা। জানেন, গঙ্গাতীরের দু’দিকের সাইরেনের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। আর সে জন্যই এ বছর এত আয়োজন। আগাগোড়া মণ্ডপ সাজিয়েছিলেন পাটের সাজে। আরামবাগের পুজো উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই আদতে কলকাতার বাসিন্দা। বিভিন্ন কারণে, প্রয়োজনে ঘর ছেড়েছেন। তাঁরাই একজোট হয়ে এখন দুর্গাপুজো করেন আরামবাগে। এই উদ্যোক্তাদের অধিকাংশেরই পরিবারের কেউ না কেউ জড়িয়ে রয়েছেন পাটশিল্পের সঙ্গে।
বাংলার বাস্তবটা এঁরা সকলেই জানেন। জানেন, পুজোর মুখে একের পর এক চটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। পুজো কমিটির কর্ণধার অভিজিৎ বসু বলছেন, “কারখানা বন্ধ হলে পরিবারগুবলির কী অবস্থা হয়, আমরা বুঝি। প্রতিবারই বাড়ি গিয়ে দেখি কোনও না কোনও চটকল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা সময় বাংলার সেরা শিল্প ছিল চট। এখন ধুঁকছে। সে সব ভেবেই তো এ বারে পুজোয় আমরা সেই শিকড়ের খোঁজে নেমেছিলাম। আপাদমস্তক পাটে মোড়ানো হয়েছে আমাদের মণ্ডপ। বাংলার শিল্পীদের এনে এ বারে সব কিছু বানানো হয়েছে।’’
আরামবাগের উদ্যোক্তারা বলছেন, গৌরাঙ্গ কুইলা তৈরি করেছেন ১৩ ফুট লম্বা দুর্গা প্রতিমা। সেটিও পাটের। মণ্ডপের ভিতরে মানানসই চিত্রকল্প বেছে নেওয়া হয়েছে রামায়ণের বিভিন্ন অনুষঙ্গ থেকে। পাটের থিমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পুজোর ক’দিন আয়োজন করা হয়েছিল
পাট শিল্পের প্রদর্শনীও। প্যান্ডেলের সামনে বসেই শিল্পীরা এ ক’দিন নানা পাটের জিনিসপত্র বানিয়েছেন। এই কর্মকাণ্ডে হাত বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকও।
আগামিকাল উৎসব শেষ। বিসর্জনের পালা। তবে আরামবাগের এই উদ্যোগ বাঁচিয়ে রাখতে চান কর্মকর্তারা। সেই মর্মে দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় প্রতিমা সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। সংগ্রহশালার লোকজন প্রতিমা দেখেও গিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি ভবনেই একটি সংগ্রহশালার উদ্বোধন হয়েছে সদ্য। সেখানে এই প্রতিমাকে জায়গা দেওয়ার চেষ্টাও চলছে।
উদ্যোক্তাদের অনেকে আবার প্রতিমাটি বিক্রি করে দেওয়ার দিকেও ঝুঁকছেন। বলছেন, তাতে কয়েক লক্ষ টাকাও তো ঘরে আসবে। দিল্লির ঝাঁ-চকচকে বিমানবন্দরে এমন অনেক শিল্পকীর্তিকেই ঠাঁই দেওয়া হয়। সে ভাবে যদি বেসরকারি হাতে পড়ে বিসর্জনের পরেও এই পাটের প্রতিমা বেঁচে থাকতে পারে!
কিন্তু সে সবে হাজার ঝক্কি রয়েছে। পুজোর প্রথম তিন দিনে কয়েক জন শিল্পপতি দেখে গিয়েছেন প্রতিমাটি। সংরক্ষণে উৎসাহ দেখিয়েছেন দিল্লি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত যে জটিলতা আছে, সেই ঝক্কি নেই মেট্রোয়।
তবে যাই হোক না কেন, এই পাট-প্রতিমা সংরক্ষণের জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন, বলছেন উদ্যোক্তারা। চাইছেন, এক দিকে যখন বাংলায় পাটশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে, তখন প্রবাসে অন্তত বেঁচে থাকুক গঙ্গাপারের এই বৃত্তান্ত!