গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
চার-চারটি বিয়ে করেছেন। গত আট বছরে পরিবারে তিন জনের মৃত্যু ঘটেছে। আর যুবক রাতারাতি হয়ে উঠেছেন বিত্তশালী! ঘটনা পরম্পরায় সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু এত দিন পুলিশের নজরে আসেনি তা। অবশেষে যুবকের চতুর্থ স্ত্রীর চিৎকার তাঁকে ধরিয়ে দিল। টনক নড়ল প্রশাসনের। যদিও তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের হাপুর জেলার বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সি বিশাল সিঙ্ঘল। ১৫ বছর আগে হাপুর থেকে মেরঠে চলে এসেছিল তাঁর পরিবার। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এক দিন আচমকা মেরঠের বাড়ি থেকে তাঁর চতুর্থ স্ত্রী শ্রেয়া চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসেন। মায়ের পিছন পিছন দৌড়োচ্ছিল এক শিশুও। সেই দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেননি মেরঠের গঙ্গানগর পাড়ার অনেকে। চিৎকার করতে করতে তরুণী বলছিলেন, ‘‘ও একটা দানব। আমি ওর সঙ্গে থাকতে পারব না।’’ সে দিনের পর বিশাল এবং তাঁর জীবনের ঘটনাবলি আলাদা করে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চতুর্থী স্ত্রী পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে দাবি করেছিলেন, নিজের বাবা, মা এবং এক স্ত্রীকে খুন করেছেন বিশাল। কৌশলে এই তিন মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে দেখিয়েছেন এবং হাতিয়ে নিয়েছেন বিমার লক্ষ লক্ষ টাকা। তাঁকেও বিশাল খুনের পরিকল্পনা করছেন বলে অভিযোগ করেন শ্রেয়া। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিশালকে তিন খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে বিমার টাকা হাতানোর একটি চক্র যে দীর্ঘ দিন ধরে সক্রিয়, তার ইঙ্গিত পেয়েছিল পুলিশ। তদন্ত শুরু হয়েছিল গত জানুয়ারি থেকে। বিশালের আগে এই সংক্রান্ত অভিযোগে আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অতীতের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর একাধিক মামলার খাতা খুলে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ। শ্রেয়ার অভিযোগের পর বিশালের পরিবারের তিন মৃত্যুর সঙ্গে বিমা সংক্রান্ত মামলাটির যোগ খুঁজে পান তদন্তকারীরা। দুইয়ে দুই চার হতে এর পর আর বেশি সময় লাগেনি।
বিমার পলিসি কেনার এক বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় ক্রেতার মৃত্যু হয়েছে— প্রাথমিক ভাবে বিমা সংস্থাগুলির কাছ থেকে এমন ঘটনার তথ্য চেয়েছিল পুলিশ। অস্বাভাবিক ভাবে কোনও হৃদ্রোগে মৃত্যু হলেও তার তথ্য পুলিশ খতিয়ে দেখছিল। সূত্রের খবর, বছর খানেক আগে বিশালের নামও পুলিশকে জানানো হয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা থেকে। কিন্তু তখন বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। শ্রেয়ার অভিযোগের পর কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে কেউটে।
কী করেছেন বিশাল?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে হাপুরে মৃত্যু হয় বিশালের বাবা মুকেশ সিঙ্ঘলের। মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখানো হয় এক ‘অজানা গাড়ি’র ধাক্কা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মুকেশের নামে মোট ৬৪টি পলিসি কেনা হয়েছিল। তার মূল্য হিসাবে পিতৃবিয়োগের পর প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতে পান বিশাল। সামান্য জ়েরক্সের দোকান চালাতেন মুকেশ। এত বিমা পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা তিনি কোথা থেকে জোগাড় করতেন? প্রশ্ন ওঠে। পুলিশের সন্দেহ আরও জোরালো হয়। যে গাড়ির ধাক্কায় মুকেশের মৃত্যু হয়েছে, সেটি চালাচ্ছিলেন বিশালের বোনের স্বামী, পরে যাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের অনুমান, বাবার মৃত্যুর পরিকল্পনা করে বোনের স্বামীকে ফাঁসিয়েছেন বিশাল। হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও মুকেশের শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন ছিল না।
চারটি বড় বড় গাড়ি ধারে কিনেছিলেন বিশাল। বাবার মৃত্যুর পর বিমার টাকা দিয়ে সে সব ঋণ পরিশোধ করেন। এ ছাড়াও একাধিক বিলাসবহুল গ্যাজ়েট তাঁর কাছে ছিল। মুকেশের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের পর ২০১৭ সালে বিশালের মা প্রভা দেবীর মৃত্যু এবং ২০২২ সালে প্রথম স্ত্রী একতার মৃত্যুও খতিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা। মায়ের মৃত্যু হয়েছিল ‘বাইক দুর্ঘটনা’য়। সেই বাইককে অজানা কোনও গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল বলে দাবি। আর বিশালের প্রথম স্ত্রী একতা মারা যান হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
একতা বিশেষ ভাবে সক্ষম ছিলেন। টানা আট দিন ধরে ডায়েরিয়ায় ভুগছিলেন তিনি। বিশাল তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। সেখান থেকে ছুটি পাওয়ার পরেই আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর বিমার ৮০ লক্ষ টাকা বিশালের পকেটে ঢুকেছিল। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, যে হাসপাতালে একতাকে ভর্তি করানো হয়, সেখানেই পরে বাবাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন বিশাল। হাসপাতাল কর্মীদের কারও কারও গোটা চক্রের সঙ্গে যোগ থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আরও তিন বার বিয়ে করেছিলেন বিশাল। যদিও কোনও বিয়েই আইন অনুযায়ী নথিভুক্ত করা হয়নি। চতুর্থ স্ত্রী শ্রেয়া ছিলেন বিবাহবিচ্ছিন্না। এক সন্তান ছিল তাঁর। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের পরেই বিমার টাকা হাতানোর কথা তাঁকে বলেছিলেন বিশাল। বাবার খুনের পরিকল্পনাও ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর কন্যাকে খুন করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন। এর পর শ্রেয়া জানতে পারে, বিশাল তাঁর নামে একটি বিমার পলিসি কেনার পরিকল্পনা করছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং বিষয়টি পুলিশকে জানান। দীর্ঘ তদন্তের পর বিশালের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশ। আপাতত জেল হেফাজতে রয়েছেন অভিযুক্ত।