ভাষা নেই মুখে। দুর্ঘটনার একদিন পরেও ঠায় দাঁড়িয়ে। রবিবার রাজঘাট সেতুতে। —নিজস্ব চিত্র।
আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়ছে না।
কাল সারাটা রাত রাজঘাট সেতুর ধারে জেগে কাটিয়েছে বারাণসী শহর। তবু আজ সকালেও ভিড়ের খামতি নেই। দূর দূর থেকে লোকজন এসে দেখছেন ঠিক কোথায়, কী ভাবে শেষ হয়ে গেল এতগুলো মানুষের প্রাণ।
কাল রাতে ঠায় সেতুর উপরে দাঁড়িয়েছিলেন ছবনলাল মিশ্র। কালকের পদযাত্রায় সামিল ছিলেন তিনি। সেতু ভেঙে যাওয়ার গুজবকে কেন্দ্র করে তখন যে যে দিকে পারছে প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছে। রাস্তার এক কোণে কোনও মতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ ছবনলাল। কাল সকালেই পড়ে গিয়ে ডান হাঁটুতে চোট পেয়েছিলেন। তাই উন্মত্ত সেই ভিড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়নোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। সেই অক্ষমতাই তাঁকে এ যাত্রা প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বৃদ্ধ। চোখের সামনে অনেককেই পায়ের চাপে দলে-পিষে যেতে দেখেছেন তিনি।
আজ সকালে ছবনলাল বললেন, ‘‘একটি মেয়ে। বড়জোর বছর ২০ বয়স। আমাকে বাবুজি বলে ডাকছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমার খুব তেষ্টা পেয়েছিল। মেয়েটি নিজের ঝোলা থেকে জলের বোতল বার করে দিল। চোখের সামনে দেখলাম, ছুটতে গিয়ে ও পড়ে গেল। আর ওকে মাড়িয়ে চলে গেল অসংখ্য মানুষ।’’ দু’হাতে মাথাটা ধরে কাতরে উঠলেন ছবনলাল।
একই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে স্থানীয় দোকানদার উমেশ প্রতাপকে। বললেন, ‘‘আমি মিছিলের শুরুর দিকে ছিলাম। তাই বেঁচে গিয়েছি। আমার পিছনে একটা ১৪-১৫ বছরের ছেলে ছুটছিল। প্রাণের ভয়ে। ওর মুখ থেকে রক্ত উঠছিল। আমি কোনও মতে ওকে ধরেছিলাম। আমার হাতেই নেতিয়ে পড়ল শেষে।’’
সেতু ভেঙে পড়ার গুজবটা কারা রটিয়েছিল, এর পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি না, সেটা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পাশাপাশি উঠছে আরও একটা প্রশ্ন। এর আগে যত বার জয় গুরুদেব বাবার ভক্তদের মিছিল হয়েছে, প্রায় প্রতিবারই কোনও না কোনও সমস্যা হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন সতর্ক হল না প্রশাসন? কেন অনুমতি দেওয়া হল ওই বিশাল জনসমাগমের? উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) দলজিৎ চৌধুরি বলেন, ‘‘আমরা ৪ হাজার মানুষের সমাগমের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় ৭ লক্ষে।’’ সেটা আগাম আঁচ করতে না পারা কি পুলিশেরই ব্যর্থতা নয়? এ়ডিজি-র জবাব, ‘‘তদন্ত চলছে। তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করব না।’’ তবে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে কালই পাঁচ পুলিশ কর্তাকে সাসপেন্ড করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। আজ আরও দু’জন যোগ হয়েছে তালিকায়। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের নির্দেশে সাসপেন্ড করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলাশাসক বিন্ধ্যবাসিনী রাজ এবং সিটি ম্যাজিস্ট্রেট বি বি সিংহকে। আজ সকালে হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে জখম এক ভক্তের। গোটা ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫।
মানুষকে নিরামিষ খাওয়ায় অনুপ্রেরণা জুগিয়ে মোক্ষলাভের পথ দেখাতেই দু’দিনের ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জয় গুরুদেব সংস্থানের মুখপাত্র রাজ বাহাদুর। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অনুষ্ঠানকে পণ্ড করার জন্য একটা মহল থেকে চক্রান্ত করা হয়েছে। আমরাও নিজেদের মতো করে তদন্ত শুরু করেছি। যারা এর জন্য দায়ী তাদের সামনে আনবই।’’
এ সব কথা অবশ্য মাথায় ঢুকছে না বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রমা সেন্টার এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অর্ধেক রোগীর। দুই হাসপাতাল মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে তিনশো। অধিকাংশের চোট এতটাই গুরুতর যে, তাঁরা কথা বলার অবস্থায় নেই। তবে শারীরিক কোনও আঘাত না পেয়েও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন, এমন মানুষের সন্ধানও মিলল আজ। কাল থেকে রাজঘাট সেতুতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও এক বৃদ্ধ। মাথায় টাক। পরনে হাফ-হাতা সাদা গেঞ্জি । কালকের ঘটনা চোখের সামনে দেখে এতটাই শক পেয়েছেন যে নিজের নামটুকুও উচ্চারণ করতে পারছেন না। তাঁর পরিচয় জানা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনায় কাউকে হারিয়েছেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না সেটাও।
এত বড় দুর্ঘটনার পরেও অবশ্য জয় গুরুদেবের শিষ্যেরা দমেননি। এ দিন বারাণসী শহর চষে বেড়িয়েছেন অনেকেই। দুপুরে বিশ্বনাথ মন্দিরের অদূরে ছোটখাটো একটা শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত শোক জ্ঞাপনের পরে দল বেঁধে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে অনেকেই লাইন দেন। তাঁদেরই এক জন, লাখনী দেবী বললেন, ‘‘দুর্ঘটনার পরেও যখন বেঁচে গিয়েছি, তখন ধরে নিতেই হবে, এটা বাবার আশীর্বাদ। তাঁকে দর্শন না করে ফিরি কী করে!’’
ঠিক কী হয়েছিল কাল? ভিড়ের ধাক্কায় কাল মারা গিয়েছেন শঙ্করী মিশ্র। তাঁর ছেলে শিবচরণ জানালেন, ‘‘আমরা সকলে রাজঘাট সেতুর কাছে জড়ো হয়েছিলাম। বেলা ১০টা থেকে ভিড়টা বাড়তে শুরু করে। পুলিশ এসে সেই সময় অনেককে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তখনই লোকজন খেপতে শুরু করেছিল। এমন সময় পুলিশের এক বড় কর্তা এসে জানান, ভিড় না কমালে লাঠিচার্জ শুরু হবে। এর মধ্যেই কে বা কারা রটিয়ে দেয়, সেতু ভেঙে পড়েছে। পুলিশ সরে যেতে বলছে।’’ শিবচরণ বলেন, ‘‘বিষয়টা সত্যি না মিথ্যে, তা বোঝার মতো অবস্থা কারও ছিল না। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দৌড় শুরু করে। কেউ এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি দিয়ে নীচে পড়ে যায়। কেউ পড়ে যায় সেতুর উপরেই। যে একবার পড়েছে, সে আর উঠতে পারেনি। যেমন আমার মা।’’
আজও ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চটি-জুতো-জামা-ব্যাগ-জলের বোতল। পুতুলও।