আম আদমি পার্টির বিক্ষোভ। ভোপালে পিটিআইয়ের তোলা ছবি।
কারও দেহ পাওয়া যাচ্ছে রেললাইনে, কেউ নিজের বাড়িতে মারা যাচ্ছেন আগুনে পুড়ে, জেলে অসুস্থ হয়ে আচমকা মৃত্যু হচ্ছে কারও। কারও দেহ মিলছে হোটেলে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরেই মুখে গ্যাঁজলা উঠে মারা যাচ্ছেন সাংবাদিক।
একটি রাজ্য জুড়ে চলা ব্যপক শিক্ষা-দুর্নীতি। আর একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘ব্যপম’ (মধ্যপ্রদেশ ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল) কেলেঙ্কারির সঙ্গে। কেউ ডাক্তারির ছাত্রী, কেউ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত, কেউ সাক্ষী, কেউ রাজসাক্ষী, কেউ তদন্তকারী চিকিৎসক।
আর কেউ বা সাংবাদিক।
২০১২-য় উজ্জয়িনীর কাছে রেললাইনের পাশে উদ্ধার হয়েছিল ডাক্তারির ছাত্রী নম্রতা ডামোরের মৃতদেহ। পুলিশের দাবি, আত্মহত্যা। নম্রতা ঘুষ দিয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছিলেন বলে অভিযোগ। সেই অভিযোগ উড়িয়ে পরিবারের বক্তব্য ছিল, ব্যপম-কাণ্ডে জড়িত কেউ খুন করিয়েছে তাঁদের মেয়েকে। গত কাল সেই নম্রতারই বাবার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক অক্ষয় সিংহ। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি। আজ আবার দিল্লির হোটেলে উদ্ধার হয়েছে জবলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মার দেহ। তাঁর আগে ওই কলেজেরই এক ডিন— ডি কে সাকল্লে রহস্যজনক ভাবে আগুনে পুড়ে মারা যান।
সরকারি হিসেবে ব্যপম-কাণ্ডে মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ২৭। বেসরকারি হিসেবে ৪৬। পরপর এতগুলো মৃত্যুতে শুধু মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান নন, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারও প্রবল অস্বস্তিতে। কারণ শিবরাজ বিজেপিরই মুখ্যমন্ত্রী। আজ রাজ্যের কাছে গোটা ঘটনার রিপোর্ট চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কিন্তু দেশজুড়ে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটা তাতে চাপা পড়ছে না। প্রত্যেকটি মৃত্যুর সঙ্গে ব্যপম-এর যোগ কেন?
২০০৯-এ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পরীক্ষার সময়ই ‘ব্যপম’-এর কাজকর্মে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মধ্যপ্রদেশে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ বিভিন্ন পেশা-শিক্ষায় ভর্তির দায়িত্বে রয়েছে ব্যপম। ২০১৩ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলায় প্রকাশ্যে আসে এই কেলেঙ্কারি। কোর্টের নির্দেশে এই ঘটনার তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) তৈরি হয়। পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স-ও তৈরি হয়েছিল। ৩২৯২টি মামলায় চার্জশিট পেশ করেছে সিট। প্রমাণ হিসেবে ৯২,১৭৬টি নথি জমা করেছে। এখনও পর্যন্ত এই মামলায় ১০৮৭টি ক্ষেত্রে জালিয়াতি ধরা পড়েছে। ২৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। প্রায় ২০০০ জন গ্রেফতার হয়েছে।
কিন্তু একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোনও কূলকিনারা করতে পারেননি তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, এক একটি মৃত্যু হলিউডের সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। অথচ একটি মৃত্যুও ছুরি-বুলেটে হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আকস্মিক মৃত্যু।
২৯ বছরের নরেন্দ্র সিংহ তোমরের ঘটনাই ধরা যাক। পশু-চিকিৎসক নরেন্দ্র ইনদওরের জেলে আটক ছিলেন। পেটে ব্যথার জন্য জেল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৯ বছরের এই যুবক। এই কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছিল মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল রামনরেশ যাদব ও তাঁর ছেলে শৈলেশের। শৈলেশও হঠাৎ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পুলিশ জানায়, তাঁর ডায়াবেটিস ছিল। বিজেপি নেতা বিজয় সিংহের নাম জড়িয়েছিল কেলেঙ্কারিতে। হোটেলের ঘরে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁরও।
তার পর জবলপুরের ওই মেডিক্যাল কলেজের দুই ডিন। ব্যপম কেলেঙ্কারিতে তাঁর কলেজেও নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে কি না, তার তদন্ত করছিলেন বর্তমান ডিন অরুণ শর্মা। ত্রিপুরা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আগরতলা মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল অরুণের। আজ সকালে দিল্লির দ্বারকার একটি হোটেলে তাঁর ঘরের দরজায় টোকা দিয়েও কোনও সাড়া পাননি হোটেলের এক কর্মী। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখা যায়, মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন ৬৪ বছর বয়সি ওই চিকিৎসক। ঘরে পড়ে রয়েছে বমি। দেহের পাশে খালি মদের বোতল। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানিয়েছে, প্রচুর মদ্যপান করেছিলেন অরুণ। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আজকেও বলেছেন, সিট গোটা ঘটনার তদন্ত করছে। অক্ষয় ও অরুণের মৃত্যুরও তদন্ত হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ব্যপম কেলেঙ্কারির বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এখনও পর্যন্ত এই কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা, রাজ্যপালের দফতরের কর্তা, মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তা, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব, ব্যপম-এর পরীক্ষা নিয়ামকের মতো বহু উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তির নাম জড়িয়েছে। কিন্তু যাকে নিয়ে মধ্যপ্রদেশে সবথেকে বেশি আলোচনা, সে হল কুখ্যাত খনি ব্যবসায়ী সুধীর শর্মা। সুধীরকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্রের বক্তব্য, ব্যপম দুর্নীতির অন্যতম পাণ্ডা সে-ই। এক সময়ে সাইকেলে করে দুধ বিক্রি করত সুধীর। মাত্র ৯ বছরের মধ্যে সে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠে। অনেকেরই সন্দেহ, সুধীর গ্রেফতার হলেও তার দলবল এখনও সক্রিয়। সুধীরকে জামিনে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। প্রভাবশালী মহলের এত বেশি সংখ্যক নাম জড়িয়ে গিয়েছে বলেই গোটা কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন তাঁরা।
কী ভাবে দুর্নীতি হয়েছিল ব্যপম-এর পরীক্ষায়?
কী ভাবে হয়নি সেটা বলা সহজ। একেবারে ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-র কায়দায় পরীক্ষায় সময় নকল, বই নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া, উত্তরের খাতা চুরি করে এনে বাড়িতে বসে উত্তর লিখে জমা দেওয়া— সব ধরনেরই জালিয়াতি হয়েছে। অনেক পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই অ্যাডমিট কার্ডের ছবি পাল্টে অন্য কেউ পরীক্ষা দিয়ে এসেছিল। অভিযোগ, উপরমহলের সুপারিশে কোনও কোনও পরীক্ষার্থী বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিয়েছিল। সিএজি রিপোর্ট বলছে, ৯ লক্ষ পরীক্ষার্থীর জন্য অ্যাডমিট কার্ড ও ‘মাল্টিপল চয়েস’ উত্তরপত্র ছাপানো হয়েছিল ২৯ লক্ষ! বাড়তি ২০ লক্ষ উত্তরপত্র কোথায় গেল, হিসেব নেই।
ব্যপম দফতরের কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কের তথ্য জমা পড়েছে দিল্লি হাইকোর্টে। মজার কথা, কাদের সুপারিশে ভুয়ো পরীক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছে, সেই তথ্যও রাখা ছিল হার্ড ডিস্কে। যে তথ্য বলছে, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজের নাম করেই ৪৮টি সুপারিশ করা হয়েছিল। আবার প্রিন্ট আউটে মুখ্যমন্ত্রীর নাম কেটে উমা ভারতীর নাম লেখা হয়েছিল। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন থেকে ব্যপম দফতরে অন্তত সাড়ে তিনশো বার ফোন গিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের একাংশের দাবি।
কাজেই তিরটা ঘুরে যাচ্ছে শিবরাজের দিকেও। তিনি যদি না-ও হন, তাঁর ঘনিষ্ঠরা যে ঘটনায় জড়িত, এই ফোনের খতিয়ানই তার প্রমাণ, বলছেন তদন্তকারীরা। বস্তুত, রাজ্যের এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব স্বীকার করেই নিয়েছেন, তিনি নিজে ৮৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
এক গোয়েন্দা-কর্তার বক্তব্য, দুর্নীতি অনেক রাজ্যেই হয়। অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীরা তাতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু একটি দুর্নীতিকে ঘিরে এত রহস্য-মৃত্যুর ঘটনা আগে ঘটেনি। এখানেই ব্যপম কেলেঙ্কারি অন্য সব কেলেঙ্কারির থেকে আলাদা।
এই সংক্রান্ত আরও খবর
ব্যপম: ডিনের পর এ বার ট্রেনি সাব-ইন্সপেক্টরের মৃত্যু