লিখতে বসে বেশ পীড়া হচ্ছে আজ। নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে, এই রক্তাক্ত পথের শেষ কোথায়? আর কত বার কলমটা ধরতে হবে এই অনর্থক রক্তপাতের বিরুদ্ধে? আর কত শব্দ, কত পংক্তি, কত পৃষ্ঠা লিখলে পরে থামবে এই বর্বরোচিত পরম্পরা, এই অবিশ্রাম রুধিরধারা?
জানি, নিজেকে জিজ্ঞাসা করে এ প্রশ্নের উত্তর পাব না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করব কাকে? কে উত্তর দেবে খুঁজে পাই না আজ। অগত্যা নিজেকেই।
নিউইয়র্ক, মুম্বই, লন্ডন, প্যারিস, ক্যালিফোর্নিয়া, ব্রাসেলস, ফ্লোরিডা-- বার বার রক্তাক্ত হয় বিশ্ব মানবতা। চূড়ান্ত কাপুরুষতার আড়াল থেকে মারণ আঘাত হানে সন্ত্রাস। নিষ্ঠুর উল্লাসে নষ্ট করে শ’য়ে শ’য়ে প্রাণ। বার বার গর্জে উঠি। তার পরও ঘটে যায় ইস্তানবুল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শরীর, ঘরের দেওয়ালে রক্তের ছিটে লেগে যায় আবার। বার বার মুছে ফেলার চেষ্টা করি রক্তের দাগ। বার বার লাল হয়ে যায় দেওয়াল, দরজা, উঠোন, পড়শির আঙিনা, রাস্তাঘাট, মাঠ-ময়দান।
আর কত? কোথাও কি শেষ নেই এই মুষল পর্বের? যে সভ্যতার বিকাশ মানবজাতির চোখে নতুন আলো দিল, রোজ নতুন নতুন আলোয় মহাবিশ্বকে চিনতে শেখাল, সমৃদ্ধি দিল, জীবনকে অপার সম্ভাবনা দিল, সেই সভ্যতার সন্তানরা এ কোন ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে মত্ত!
সংশয় হয়। এঁরা সকলে সভ্যতার সন্তান তো?
ইরাকে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়, মিশরে, গোটা মধ্য এশিয়ায় এই সঙ্কট এখন সবচেয়ে ঘনীভূত। রক্তস্রোত নিয়মিত। তার গা ঘেঁষে থাকা তুরস্ককেও গত এক বছর ধরে বার বার রক্তাক্ত হতে হচ্ছে। আশ্চর্য হই সন্ত্রাসের এই ভৌগোলিক স্থিতি দেখেই! সভ্যতার সূর্যের প্রথম কিরণ পৃথিবীর এই অংশেই তো পড়েছিল। মেসোপটেমিয়া আর মিশরের হাত ধরে মানবজাতি জীবনের নতুন দিশা পেয়েছিল। সভ্যতার সেই আঁতুড়ঘরেই এখন সভ্যতার চিতাকাঠ সাজানো হচ্ছে যেন!
নিরাশ হওয়ার সময় নয়। নরসংহারকের সামনে আত্মসমর্পণের সময়ও নয়। বরং সর্বশক্তি দিয়ে বিপথগামীকে সভ্যতার মহাসড়কে ফেরানোর সময় এ।
আশার আলোও কিন্তু জ্বলছে কোথাও। সভ্যতার আর এক আদি গুম্ফা থেকে সেই আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা গিয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার ভূমি থেকে হিনা রব্বানি খার নামে এক নেত্রী বলছেন, যুদ্ধে সমাধান হয় না। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তান কাশ্মীর জয় করতে পারবে না। আলোচনাই সমাধানের এক মাত্র পথ। আর তার জন্য সম্পর্ক স্বাভাবিক করাই প্রাথমিক কর্তব্য।
হিনা রব্বানি খার গতানুগতিক রাজনীতিরই প্রতিভূ। তিনি পাকিস্তানের সরকারে মন্ত্রী থাকাকালীন শান্তির লক্ষ্যে দৃষ্টান্তমূলক কিছু করে যেতে পেরেছেন, তেমন নয়। রাজনীতিক হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয় তিনি, তেমনও বলতে পারি না। তবু কথাগুলো তিনি উচ্চারণ যে করেছেন তা অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষীণ হলেও, সভ্যতার কোনও আদি ভূমি থেকে সঙ্কটমুক্তির বাণী যে উৎসারিত আজও হচ্ছে, তা অস্বীকার করতে পারি না।
আশান্বিত হতেই হবে। সভ্যতার আঁতুড়ে সভ্যতার সমাধিক্ষেত্র তৈরি হবে না, এ বিশ্বাস রাখতেই হবে।