কী কারণে ভোগান্তির শিকার ইন্ডিগোর যাত্রীরা? —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
টানা তিন দিন ধরে বিপর্যস্ত ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা। শুক্রবার ওই বেসরকারি বিমানসংস্থার ৬০০-রও বেশি উড়ান বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু পরিষেবা এবং যাত্রীসংখ্যার নিরিখে দেশের বৃহত্তম বিমানসংস্থা ইন্ডিগোর পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ যাত্রী অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন।
যাত্রীদের এই ভোগান্তি অবশ্য চলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। বৃহস্পতিবার সারা দিনে মোট ৫৫০টি উড়ান বাতিল করেছিল ইন্ডিগো। বৃহস্পতিবার দিনভর এবং শুক্রবার সকালে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে সার্বিক অব্যবস্থাই লক্ষ করা গিয়েছে। ইন্ডিগোর যাত্রীদের অভিযোগ, যথাযথ খাবার এবং আশ্রয় ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন তাঁরা। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের উড়ান ছাড়বে, তা বিমানসংস্থার তরফে জানানো হচ্ছে না। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্য বিমানসংস্থাগুলি বিমানের টিকিটের দাম চড়চড় করে বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
কী কারণে এই ইন্ডিগো বিভ্রাট
ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার নেপথ্যে দেশের উড়ান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ-র একটি বিধিকে দায়ী করা হচ্ছে। বিমান পরিষেবায় নিরাপত্তা আরও মজবুত করতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পাইলট এবং বিমানকর্মীদের কাজের সময় এবং বিধি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল ডিজিসিএ। ‘ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশনস’ নামের ওই বিধিতে বলা হয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে পাইলট এবং বিমানকর্মীদের বিশ্রামের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে মাত্র ২টি বিমান রাতে অবতরণ করাতে পারবেন এক জন পাইলট (আগে সংখ্যাটা ছিল ৬)। তা ছাড়া ওই বিধিতে বলা হয়, পাইলট এবং বিমানকর্মীদের পর পর দু’দিন নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে সপ্তাহে এক বারই। ২০২৪ সালের জুনেই এই বিধি কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু বিমানসংস্থাগুলির অনুরোধে তা বার বার পিছিয়ে যায়। সম্প্রতি নতুন বিধি কার্যকর করার জন্য ডিজিসিএ-কে নির্দেশ দেয় দিল্লি হাই কোর্ট। জুন এবং নভেম্বরে দুই দফায় ধাপে ধাপে নির্দেশিকায় থাকা নিয়মাবলি কার্যকর করার পথে হাঁটে ডিজিসিএ।
ইন্ডিগো-ই কেন বেশি সমস্যায়
ইন্ডিগো তুলনায় সস্তায় বিমান পরিষেবা দিয়ে থাকে যাত্রীদের। পরিষেবা দেওয়ার সংখ্যা বিচার করলে এয়ার ইন্ডিয়ার তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে ইন্ডিগো। দেশের ৯০টি এবং বিদেশের ৪৫টি বিমানবন্দরে পরিষেবা দিয়ে থাকে তারা। ইন্ডিগোর অনেক বিমানই রাতে অবতরণ করে। তাই নয়া বিধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে এই বিমানসংস্থাই। নয়া বিধি মেনে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে যত সংখ্যক কর্মী এবং পাইলট প্রয়োজন, বর্তমানে তা ইন্ডিগোর নেই। পাইলট এবং কর্মী অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে ইতিমধ্যেই যাত্রীদের কাছে একাধিক বার ক্ষমাও চেয়েছে ইন্ডিগো।
কী অভিযোগ পাইলট সংগঠনগুলির
পাইলটদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান পাইলটস’-এর অভিযোগ, ডিজিসিএ নতুন নিয়মাবলি নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রায় দু’বছর কেটে গিয়েছে। অন্য বিমানসংস্থাগুলি সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ইন্ডিগো দীর্ঘ সময় ধরে নতুন পাইলট এবং বিমানকর্মী নিয়োগ করেনি বলে অভিযোগ। সংগঠনটির এ-ও অভিযোগ, নয়া বিধি কার্যকর হবে, তা জেনেও দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা করেনি ইন্ডিগো। বরং দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে। পাইলটদের আর এক সংগঠন ‘দ্য এয়ারলাইন্স পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন’-এর আবার দাবি, বিধি শিথিল করতে কেন্দ্রকে বাধ্য করার কৌশল নিয়েছিল ইন্ডিগো। সেই কারণেই বিমান পরিষেবা ব্যাহত হলেও ইন্ডিগো কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করেনি বলে দাবি ওই সংগঠনের।
তদন্তের নির্দেশ কেন্দ্রের
বৃহস্পতিবার রাতে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে পরিষেবার উপর ‘নেতিবাচক প্রভাব’ পড়ার জন্য প্রযুক্তিগত ত্রুটি, শীতকালীন সময়সূচি পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বিমান ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান যানজট এবং বিমানকর্মীদের কাজের সংশোধিত সময়সূচিকে দায়ী করেছে ইন্ডিগো। তবে কী কারণে এই বিভ্রাট, তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক।
বিধি শিথিল করল কেন্দ্র
ডিজিসিএ-র আগের নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, পাইলট বা বিমানচালকদের নেওয়া ছুটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রামের যে নির্দিষ্ট সময়সীমা, তার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ, পাইলটরা আগাম ছুটি নিন বা না-নিন, সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বিশ্রাম দিতেই হবে তাঁদের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুক্রবার এই সংক্রান্ত নিয়মটি শিথিল করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক করার কথা বলা হলেও মনে করা হচ্ছে, ইন্ডিগোকে সুরাহা দিতেই বিধি শিথিল করা হয়েছে।
প্রশ্নে কেন্দ্রের ভূমিকাও
ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আসরে নেমেছে দেশের অসামরিক বিমান পরিবহণ সংস্থা। বিমানমন্ত্রী রামমোহন নায়ডু সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্ত্রকের আধিকারিক এবং ইন্ডিগো কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে ইন্ডিগোর তরফে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল যে, তাদের পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক করার জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক। মন্ত্রী আসরে নামলেও প্রশ্ন উঠছে যে, পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার পরেও কেন এত দিন নড়েচড়ে বসেনি কেন্দ্র। নিয়মবিধি মানার ক্ষেত্রে ইন্ডিগোকে কেন চাপ দেওয়া হয়নি, উঠছে সেই প্রশ্নও। তা ছাড়া আপাতত একটি বিধি শিথিল করার কথা বলা হলেও, তা কত দিনের জন্য স্পষ্ট নয়। ইন্ডিগোর ‘চাপের কৌশলে’ কেন্দ্র নতিস্বীকার করল কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।
কী বলল ইন্ডিগো
কেন্দ্র বিধি শিথিল করার পর ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক হবে কি না, হলেও কবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে শুক্রবার দুপুরে আরও এক বার যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিমানসংস্থাটি জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমান বাতিল হলে পুরো টাকা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমানের জন্য অপেক্ষারত ইন্ডিগোর যাত্রীরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের খাবার এবং পানীয় জলও দেওয়া হচ্ছে না। শুক্রবার বিমানসংস্থা জানিয়েছে, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের কাছে খাবার এবং জল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। যাত্রীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন শহরে হোটেলের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ইন্ডিগো।