JNU student

‘আমাদের সকলের গায়ে কমবেশি কালশিটের দাগ!’

পুলিশ ৫ দিন পর তাঁকে গ্রেফতার করে। কিন্তু, ঘাড়ের উপর ৮টি মামলা থাকলেও তিনি ৪৫ মিনিটের মধ্যে জামিন পেয়ে যান। জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এখনও অবধি অধ্যাপক জোহরিকে সব পদে বহাল রেখেছেন।

Advertisement

শ্রেয়সী বিশ্বাস, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের গবেষক

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪১
Share:

‘লং মার্চ’-এ প্রতিবাদ।

বছর দুয়েক ধরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। অধ্যাপক জগদীশ কুমার উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই উত্তেজনার পারদ নামার চেয়ে যেন বেড়েই চলেছে। কিন্তু সম্প্রতি ‘লং মার্চ’কে কেন্দ্র করে যা হল, তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য তো বটেই, ছাত্রছাত্রীদের জন্যও ভয়ঙ্কর লজ্জার। এবং ভয়েরও।

Advertisement

আমরা কেন ‘লং মার্চ’-এর পথে হাঁটলাম? তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতটাই একটু জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। তার পর জানাব ‘লং মার্চ’-এ আমাদের ঠিক কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দিন ধরেই নানা অভিযোগ উঠছিল। তার মধ্যে অন্যতম, তিনি কিছু অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এর স্বায়ত্ব ব্যবস্থা নষ্ট করে সেখানে একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন। আলোচনা ছাড়াই পরিচালন সমিতির বৈঠকে একের পর এক বিষয় পাশ করানো হয়েছে। বৈঠকের বিবরণী বিকৃত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশিকাকে শিখণ্ডি খাড়া করে আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি করার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। পরিচালন সমিতির বৈঠকে পাশ না হওয়ার পরেও পড়ুয়াদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি। এমফিল-পিএইচডির তো ক্লাসই হয় না, তার পরেও এটার মানে কী!

Advertisement

ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ৯৫ শতাংশই এই নির্দেশিকাকে বয়কট করেছে। প্রতিবাদও জানিয়েছে। কিন্তু, তার ফল ভাল হয়নি। এক দিন হঠাৎ করে ৮ জন চেয়ার পার্সন এবং ডিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সবের পাশাপাশি ছাত্র সংসদের সদস্য বা ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর তো এখন জলভাতের মতো ব্যাপার। সঙ্গে রয়েছে ২০ হাজার টাকার জরিমানাও। এ ছাড়া আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘গ্রেডেড অটোনমি ক্লজ’ আনা হয়েছে। এর জেরে কমবে তহবিল। ফেলোশিপের সংখ্যাও কমবে। তবে, ফি বাড়বে।

প্রতিবাদ-মিছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিগ্রহ সমাধান সংক্রান্ত একটি কমিটি ছিল। তার নাম ছিল, ‘জেন্ডার সেনসিটাইজেশন কমিটি এগেইনস্ট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ (জিএসসিএএসএইচ)। নির্বাচিত এবং স্বায়ত্তশাসিত সেই কমিটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ইন্টারনাল কমপ্লেনান্ট কমিটি’ (আইসিসি)। এটি সম্পূর্ণ বাবে মনোনীত একটি কমিটি। অভিযোগ, মনোননয়ের গোটাটাই করেন খোদ উপাচার্য। প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীরা আলাদা ভাবে নির্বাচিত জিএসসিএএসএইচ গঠন করে। আশার কথা, জেএনইউ ক্যাম্পাস এখনও তাতেই ভরসা রাখে।

আর সেই কারণেই গত ১৬ মার্চ ৮ ছাত্রী আইসিসি-র কাছে না গিয়ে পুলিশের কাছে এফআইআর করেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতুল জোহরির বিরুদ্ধে তাঁরা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করেন। পুলিশ ৫ দিন পর তাঁকে গ্রেফতার করে। কিন্তু, ঘাড়ের উপর ৮টি মামলা থাকলেও তিনি ৪৫ মিনিটের মধ্যে জামিন পেয়ে যান। জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এখনও অবধি অধ্যাপক জোহরিকে সব পদে বহাল রেখেছেন।

এ সব কিছুর প্রতিবাদেই আমরা অর্থাৎ জেএনইউ শিক্ষক সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠন একসঙ্গে লং মার্চের ডাক দিয়েছিলাম। অনুপ্রেরিত হয়েছিলাম মহারাষ্ট্রে কৃষকদের ওই লং মার্চ দেখে। সেই মিছিলে জেএনইউ ছাড়াও দিল্লির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দেয়। অনেকেরই পার্লামেন্ট স্ট্রিট থেকে আমাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ইউনিয়নের তরফে আমরা অন্তত ৫০-৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিলাম। মিছিলে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল, গ্লুকোজ, বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসার সব রকম বন্দোবস্তই ছিল। রাস্তাতেও জল-বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল।

আরও পড়ুন: বীজ বুনছে সঙ্ঘ, পার্টি কংগ্রেসে শিখবেন কারাটেরা

দিল্লির নাগরিকদের অসুবিধা না করে যাতে মিছিল যায়, সে জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা দড়ি দিয়ে লাইন বেঁধে দিয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্র-শিক্ষক একসঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে প্ল্যাকার্ড হাতে এগিয়ে গিয়েছেন। প্রথম থেকেই সংবাদ মাধ্যম এবং পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মী আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মিছিল শান্ত ভাবে এগিয়ে চলে চার পাশের মানুষকে লিফলেট বিলি করতে করতে।

পড়ুয়াদের প্রতিবাদ-সমাবেশে বৃন্দা কারাত।

ভিকাজি কামার সামনে থেকে হঠাত্ মিছিলটি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। কিছু দূর গিয়ে আইএনএ-র সামনে গিয়ে দেখি, প্রচুর পুলিশ, সারি সারি জলকামান আর ব্যারিকেড। আমাদের জানানো হয়, এই মিছিলের অনুমতি নেই। ওখানে উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলতে যান আমাদের ছাত্র সংসদের সদস্য এবং শিক্ষকরা। কথা বলার পর পুলিশ প্রাথমিক ভাবে মিছিল এগোতে দিতে রাজি হয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই মত বদলে ঘোষণা করে, মিছিল না সরালে জলকামান দাগা হবে!

এর পরেই ছাত্রদের একটা অংশের সঙ্গে পুলিশের বচসা বাধে। গীতা (সভাপতি, জেএনইউএসইউ) এবং আমি ক্রমাগত শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রদের শান্ত করতে থাকি। কেন না, আমরা কোনও রকম সংঘর্ষের পক্ষে ছিলাম না। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, প্রচুর ছাত্রী মিছিলে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত মহিলা পুলিশ কিন্তু সেখানে ছিলেন না। এর মধ্যেই আমাদের পিছনে থাকা পুলিশ কর্মীরা কনুই দিয়ে পিঠে, কাঁধে আঘাত করতে থাকেন। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে সজোরে একটা হাত এসে পড়ে আমার ডান চোখের পাশে।

আরও পড়ুন: মোদীর অ্যাপেই তথ্য ফাঁস, খোঁচা রাহুলের

কেউ এক জন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। পুলিশ তাঁকে দেখে একটু পিছিয়ে যায়। জনাকয়েক পুলিশ কর্মী সেই ফোটোগ্রাফারের দিকে এগিয়ে যায়। এর পর ভিড়ের মধ্যে আমি আর কিছু দেখতে পাইনি। বরং বলা ভাল দেখা সম্ভব হয়নি। তবে পিছন থেকে ক্রমাগত ভারী বুট দিয়ে আমার পায়ে লাথি মারা হচ্ছিল। আমার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। আমি ওখান থেকে বেরিয়ে তুলনামূলক ফাঁকা জায়গায় চলে যাই। এর পাঁচ মিনিট পরেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান দাগে পুলিশ। এমনকী, যেখানে কোনও গোলমাল ছিল না জলকামান সেখানেও দাগা হয়।

এ সবের মধ্যেই কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে পুলিশ মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় ব্যারিকেডের ও-পারে। তারা ছাড়া পাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করলেও ছাড়া হয়নি। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষকরা কথা বলছিলেন পরিস্থিতি নিয়ে। কিন্তু, তার মধ্যেই লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। লাঠির ঘায়ে আহত হন আমাদের লেবার স্টাডিজের শিক্ষক প্রদীপ শিন্ডে। পালাতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ছুঁড়ে মারতে থাকে পড়ে থাকা জুতো। একটি জুতো এসে লাগে আমার পিঠে। এই সময়ে পদপিষ্টের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত!

মিছিল থেকে ২৩ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রীদের পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। এদের সকলের মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়েছে এইমসে। আমাদের সকলের গায়ে কমবেশি কালশিটের দাগ এবং মারের চোটে গায়ে অসহ্য ব্যথা রয়েছে। কয়েক জনের আঘাত গুরুতর। কিন্তু, এ নিয়ে দিল্লি পুলিশের মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই।

কিন্তু, এত কিছু করেও পড়ুয়াদের দমানো যায়নি। যত ক্ষণ না বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এসে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন, তত ক্ষণ তারা সেখানেই বসে থাকে। এ দিনের ঘটনার পর দু’জন সাংবাদিকও পুলিশের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করেছেন। ঘটনাটি যাঁরা ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন তাঁদের অনেকেরই ফোন, ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। নয়তো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে লাঠিচার্জের অভিযোগ।

তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছে দিল্লি পুলিশ। আরও বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্ররা। শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং গৈরিকীকরণের প্রভাব জেএনইউ-তে প্রবল ভাবে স্পষ্ট। এই লড়াইটা আমাদের একার নয়। আমাদের একার জন্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার এবং সেই অধিকার সুরক্ষিত করতে একটি ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রয়োজন। তাই এই ‘লং মার্চ’ আপাতত চলবেই। জেএনইউ থেকে আমরা এই বার্তাই দিতে চেয়েছি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে।

ছবি পিটিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন