অনলাইন বেটিং অ্যাপ-কাণ্ডে ইডির নজরে একঝাঁক তারকা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
অনলাইন বেটিং অ্যাপের মাধ্যমে আর্থিক তছরুপের অভিযোগ। তা-ই নিয়ে দেশ জুড়ে তদন্ত করছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বলিউড থেকে টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রাক্তন খেলোয়াড় থেকে নেটপ্রভাবী, কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সমন পাচ্ছেন একের পর এক এক খ্যাতনামী এবং পরিচিত মুখ। কিন্তু কোন কোন বেটিং অ্যাপের জন্য ডাক পড়ছে তাঁদের? অভিযোগ ঠিক কী? এ পর্যন্ত কত জনই বা ইডির ডাক পেলেন? একনজরে দেখে নেওয়া যাক নানা বেটিং অ্যাপ নিয়ে ইডির কর্মকাণ্ড।
কোন কোন বেটিং অ্যাপের জন্য ইডির সাম্প্রতিক অভিযান?
ঠিক কোন কোন বেটিং অ্যাপের জন্য ইডির সমন পাচ্ছেন তারকারা, তার সব ক’টির নাম এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে এ পর্যন্ত দুটো অ্যাপের নাম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একটি রামি অন্যটি ওয়ানএক্স বেট। উল্লিখিত প্রথম অ্যাপটির জন্য বিপাকে পড়েছেন দক্ষিণ ভারতের একঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কুশীলব। দ্বিতীয়টির জন্য ইডির ডাক পেয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহ, শিখর ধবন, রবিন উথাপ্পা, সুরেশ রায়না থেকে টলিউডের দুই তারকা মিমি চক্রবর্তী এবং অঙ্কুশ হাজরা।
ওয়ানএক্সের জন্য বিপাকে যাঁরা
‘ওয়ানএক্স বেট’ নামক অনলাইন বেটিং অ্যাপটিকে আরও কয়েকটি অ্যাপের সঙ্গে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে মোদী সরকার। ওই অ্যাপের প্রচারমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথম সারির তারকারা। ওয়ানএক্স বেটের সঙ্গে তাঁদের কী চুক্তি হয়েছিল, কত টাকা নিয়েছেন তা নিয়ে ইডি জবাব তলব করেছে ২০১১ সালে বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য যুবরাজের। ৪৩ বছরের যুবরাজকে হাজিরা দিতে হবে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর। তার আগে লাইনে আছেন উথাপ্পা। ৩৯ বছরের ক্রিকেটারকে ইডির সদর দফতরে (দিল্লি) হাজির হতে হবে ২২ সেপ্টেম্বর। এবং এই লাইনে পরে রয়েছেন করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মসিহা হয়ে ওঠা অভিনেতা সোনু সুদ। ইডি সূত্রে খবর, আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা। ধবনের মতো এই তিন জনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি বিরোধী আইনের (পিএমএলএ) অধীনে জিজ্ঞাসাবাদ করে বয়ান নথিবদ্ধ করা হবে।
ওয়ানএক্স বেট অ্যাপের প্রচারের জন্য গত সোমবার তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ তথা অভিনেত্রী মিমির বয়ান নথিবদ্ধ করেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। মঙ্গলবার দিল্লিতে ইডির সদর দফতরে গিয়েছেন টলিউডের হিরো অঙ্কুশ। অন্য দিকে, বলিউডের উর্বশী রৌতেলা আবার ওই ওয়ানএক্স বেট অ্যাপের ভারতীয় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন। গত অগস্টেই এক বার হাজিরা দিয়েছেন তিনি।
কোভিডে সাধারণ মানুষের মসিহা সোনু সুদও বিপাকে! —ফাইল চিত্র।
ওয়ানএক্স বেট অ্যাপটি ঠিক কী?
এককথায় অনলাইনে জুয়া খেলার অ্যাপ। সরকার চিহ্নিত অবৈধ বেটিং অ্যাপগুলির মধ্যে একটি। অভিযোগ, অসংখ্য মানুষ এবং বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করেছে এরা। সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ। যেহেতু ওই অ্যাপের বিজ্ঞাপনী প্রচারে জড়িত একাধিক তারকা এবং সমাজমাধ্যম প্রভাবী, নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারেন না তাঁরা, বলছে ইডি।
অন্য দিকে, সংশ্লিষ্ট অ্যাপ কর্তৃপক্ষটির দাবি, তাঁরা বিশ্বে পরিচিত ‘বুকমেকার।’ বেটিং ‘শিল্পে’ গত ১৮ বছর ধরে রয়েছেন। এই অ্যাপে হাজারখানেক প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলোয় বেটিং লড়তে পারেন ব্যবহারকারীরা। কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ৭০টি ভাষায় তাদের অ্যাপে বেটিং লড়া যায়।
দোসর রামি বেটিং অ্যাপ
গত বছর বলিউড এবং দক্ষিণী সিনেমার অনেক মুখকে ডেকেছে ইডি। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম বিজয় দেবরকোন্ডা, রানা দগ্গুবাতী, প্রকাশ রাজ। ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন হরভজন সিংহ, সুরেশ রায়নারা। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় রামি, ওয়ানএক্স-সহ বেশ কিছু বেটিং অ্যাপের প্রচার করেছেন।
ইডির ডাক পেয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার সুরেশ রায়নাও। —ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন বেটিং অ্যাপের প্রচারে জড়িয়ে বিপাকে যাঁরা
রবিন উথাপ্পা, যুবরাজ সিংহ, সোনু সুদ, শিখর ধবন, সুরেশ রায়না, মিমি চক্রবর্তী, অঙ্কুশ হাজরা, উর্বশী রৌতেলা, লক্ষ্মী মঞ্চু, রানা দগ্গুবাতী, প্রকাশ রাজ, বিজয় দেবরকোন্ডা। এ ছাড়াও রয়েছেন কিছু ইউটিউবার এবং স্বল্পপরিচিত মুখ।
বিতর্কের মুখে কোন তারকা কী বললেন?
গত বছরের মার্চে ‘ডিয়ার কমরেড’, ‘অর্জুন রেড্ডি’ খ্যাত দেবরকোন্ডা বিবৃতিতে বলেন, তিনি যখন চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তখন তাঁকে জানানো হয়েছে, অ্যাপটি ‘দক্ষতাভিত্তিক গেমিং’ অ্যাপ। তিনি জানান, রামির মতো দক্ষতাভিত্তিক গেমিং অ্যাপকে সুপ্রিম কোর্ট জুয়া থেকে আলাদা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং আইনত অনুমোদিত বলেছিল। সে সব দেখেশুনে প্রচারে যোগ দিয়েছিলেন।
একই কথা বলছেন ‘বাহুবলী’র খলনায়ক দগ্গুবাতী। তবে তিনি এ-ও দাবি করেছেন, একটি গেমিং অ্যাপের সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি হয়েছিল। ২০১৭ সালেই তা শেষ হয়ে যায় এবং তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে বিস্তর কথাবার্তা বলেই ওই অ্যাপের প্রচার করেছেন। জ্ঞানত কোনও অন্যায় করেননি। অভিনেতা প্রকাশ রাজ জানান, ২০১৬ সালে একটি গেমিং অ্যাপের প্রচারের একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু এক বছর পর আর চুক্তির মেয়াদ বাড়াননি। ২০২১ সালে যখন অন্য একটি কোম্পানি ওই ব্র্যান্ডটি কিনে নেয়, তারা তাঁর পুরনো ভিডিয়োগুলো প্রচারের কাজে ব্যবহার করেছেন। তিনি আপত্তি করার পরে তা সরিয়েও নেয় সেই কোম্পানি। রাজনীতিবিদ তথা অভিনেতা বলেছিলেন, ‘‘আমি তরুণদের কোনও রকম জুয়া খেলতে বারণ করছি। এ সব জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।’’
‘বাহুবলী’র বল্লালদেব রানা দগ্গুবাতীও ইডির নজরে। —ফাইল চিত্র।
বাজি লাগাও!
২০২৩ সালে দেশ জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিল মহাদেব বেটিং অ্যাপ। ছত্তীসগঢ়ে রাজনীতির পাশা উল্টে যাওয়ায় বাজি-অ্যাপের কারবারকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন বাজার বিশ্লেষণী সংস্থা এবং তদন্ত সংস্থাগুলির মতে, অনলাইন বেটিং অ্যাপগুলির সঙ্গে দেশের প্রায় ২২ কোটি মানুষ জড়িয়ে। এঁদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক (প্রায় ১১ কোটি) নিয়মিত বেটিং অ্যাপ ব্যবহার করেন। ইডি দেশ জুড়ে ‘অবৈধ জুয়া এবং বাজি’র প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি মামলার তদন্ত করছে। যার মধ্যে রয়েছে মহাদেব অনলাইন বুক (এমওবি) অ্যাপ। এদের প্রধান প্রোমোটারেরা ছত্তীসগঢ়ের বাসিন্দা। কেন্দ্র সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করতে ১৫২৪টি নির্দেশ জারি করেছে তারা।
খেলা ভিত্তি, বেটিং ভবিষ্যৎ?
গত কয়েক বছর ধরে গেমিং ‘শিল্প’ একটি উদীয়মান ক্ষেত্র হিসাবে উঠে এসেছে। আইপিএল থেকে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, খেলা দেখতে বসলে এখন প্রচুর দর্শকের চোখ থাকে টিভিতে, হাত থাকে মোবাইলের বেটিং অ্যাপে। মাথায় ঘুরছে অদ্ভুত সমস্ত হিসাব।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, অনলাইন গেমে বাজি ধরার নেপথ্যে প্রতি মাসে ভারতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে গেমিং শিল্পে ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ছোটবড় সংস্থা। শহরের যুবক-যুবতী থেকে মফস্সলের কিশোর-কিশোরীর খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন গেমিং অ্যাপে বাজি লড়া এক রকমের আসক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে।
জুয়ার নেশা
ব্রিটেন, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতেও অনলাইন গেমিং ভীষণ জনপ্রিয়। তবে তা নিয়ে অনেক কড়াকড়ি রয়েছে। কেওয়াইসি, বিজ্ঞাপন ও প্রচারের নানা নিয়ম রয়েছে। এ দেশেও সম্প্রতি ‘দ্য প্রোমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অনলাইন গেমিং বিল’ আনা হয়েছে। সেপ্টেম্বরেই সেই বিলে অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
তা-হলে অনলাইন গেম নিষিদ্ধ ভারতে?
কেন্দ্র জানিয়েছে, আর্থিক লেনদেন রয়েছে, এমন কোনও অনলাইন গেম খেলতে পারবে না দেশের আমজনতা। শুধু তা-ই নয়, যে অনলাইন গেমগুলিতে পুরস্কারমূল্য রয়েছে, সেগুলিও খেলা যাবে না। সংশ্লিষ্ট গেমগুলিকে নতুন আইনের আওতায় পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় প্রশাসন। এই আইন চালু হওয়া ইস্তক ‘রিয়্যাল মানি গেম’, ‘পোকার’ বা ‘রামি’র মতো ফ্যান্টাসি গেমগুলি রাতারাতি বন্ধ হয়েছে। তবে যে গেমগুলিতে আর্থিক লেনদেনের কোনও বিষয় নেই সেগুলি দিব্যি চালু রয়েছে। কিছু অনলাইন গেম আবার শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে বা শুধুমাত্র মজা করার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। সেগুলি খেলার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
ধরা পড়লে শাস্তি কী?
নিষেধের পরেও লুকিয়ে আর্থিক লেনদেন-যুক্ত অনলাইন গেম খেললে কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে সদ্য পাশ হওয়া কেন্দ্রীয় আইনে। জামিন-অযোগ্য ধারায় অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করতে পারবে পুলিশ। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ফলে অনলাইন বা ফ্যান্টাসি গেম খেলার আগে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী গোপা বিশ্বাসের কথায়, ‘‘বেটিং অ্যাপ নিয়ে নির্দিষ্ট করে কোনও শাস্তির কথা বলা নেই। তবে সেখানে কী ধরনের প্রতারণা হচ্ছে, তা দেখতে হবে। প্রতারণার ধরন দেখে মামলা দায়ের করা হয়। আর্থিক প্রতারণার ক্ষেত্রে দোষীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।’’