Jaipur Literature Festival

নাগাদের আটপৌরে যাপন, দলিতদের ভীতি ভাষা পেল এস্টেরিন আর ইয়াশিকার কথায়

নাগাল্যান্ডের মেয়ে এস্টেরিন কিরে লেখাপড়া করেছেন কোহিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি করতে ভাল লাগত ছোটবেলা থেকেই।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

জয়পুর শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০ ১৯:৩৭
Share:

এস্টেরিন এবং ইয়াশিকা। —ফাইল চিত্র।

দু’জনের গল্প এক নয়। তবু জয়পুরের সাহিত্য উৎসবে এসে কোথায় যেন মিলে গেল দুই নারীর স্বর।

Advertisement

তবে শুধু মহিলা লেখক বলে নয়। কথায় কথায় মেয়ে লেখকদের এক করে দেওয়া হয়। ভেবে নেওয়া হয় ‘মেয়েদের’ কথা বলেন এঁরা সকলেই। বলেন তো বটেই। তবে মেয়ে মানেই তো এক নয়। এক-এক জায়গার মহিলা, এক-এক সমাজের কন্যা, এক-এক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে তাঁদের জীবন। দু’জনেই নিজের জন্মস্থান ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে নতুন করে খুঁজছেন আত্মসম্মান। সঙ্গে কথা বলছেন নিজের জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে। সেই কাজ করতে গিয়ে বারবার মিলে যাচ্ছে এই কন্যাদের ধারণা, ভাবনা, ইচ্ছে, দায়িত্ববোধের প্রকাশ।

নাগাল্যান্ডের মেয়ে এস্টেরিন কিরে লেখাপড়া করেছেন কোহিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি করতে ভাল লাগত ছোটবেলা থেকেই। তবে শুধু ভাল লাগার জন্য লেখায় আরাম নেই তাঁর। বড় হওয়ার সময়ে তিনি দেখে নিয়েছেন, নিজেদের কথা জোর গলায় না বলতে পারলে কী কী হতে পারে। মৃদুভাষী এস্টেরিন জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভালের মঞ্চে আলোচনাসভা সেরে একান্ত আড্ডায় আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেন, ‘‘সকলে ধরে নেন নাগারা হিংস্র জাত। মানুষ মেরে খান। কত না সব গল্প আমাদের নিয়ে। আমাদের যে এতে কতটা অসম্মান হয়, তা কেউ ভেবেছেন কখনও? আমরা কেমন, সে তো আমাদের রাজ্যে গিয়ে দেখলেও হয়।’’

Advertisement

এস্টেরিনের রাজ্যে গিয়ে, সেখান থেকে ফিরে এসেও গল্প ‘বানানো’ থামেনি। তাই নিজের সমাজের সম্মান রক্ষা করতে কলম তুলে নিয়েছিলেন এই নাগা-কন্যা। ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রকাশ করা প্রথম নাগা মহিলা তিনি। লেখেন মূলত নাগা সমাজের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে। বলেন, ‘‘রোজনামচা লিখলে মানুষে বুঝবে, আমরাও বাকিদের থেকে আলাদা নই। আমাদের জীবনও স্বাভাবিক ছন্দে চলে।’’আর ইংরেজিতে লেখাটা একান্তই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যে ভাষা বেশি সংখ্যক মানুষ পড়েন, তিনি সে ভাষাতেই লিখতে চান। তাই লেখালেখি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সুযোগ নরওয়ে থেকে আসা মাত্র সেই দেশে পাড়ি দেন তিনি। গত এক দশকেরও বেশি তিনি সে দেশেই কাটিয়েছেন। দু’টি জায়গাই নিজের বাড়ি বলে মনে করেন। আর সঙ্গে মনে করেন, নাগা মানুষের গল্প বলার জন্য বিদেশ থেকে বই প্রকাশ করা জরুরি। তাতে যদি কয়েক জন বেশি পাঠক পাওয়া যায়, সেটাই তো এক জন লেখকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

আজমেরের বাড়ি ছেড়ে, দিল্লিতে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে করতেই প্রথম নিজের সমাজের কথা বলার জোর পান দলিত লেখক ইয়াশিকা দত্ত। এ দেশেই বড় হয়েছেন। ভালমন্দ মিশিয়ে নিজের ভাবনা-ধারণা সবই তৈরি করে নিয়েছিলেন, তবু নিজেদের দলিত বলতে ভয় পেয়েছেন। ইয়াশিকা বলেন, ‘‘এই ভয়টা আসলে নিজে থেকে আসে না। ভয়ের সঙ্গেই বড় হয়েছি আমরা। বাড়িতে শেখানো হয়েছে ভয় পেতে। কারণ বাড়ির বড়রা সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বারবার।’’ তাই নিজেদের আসল নাম কখনওই বলার নিয়ম ছিল না। পরিবার সকলেই ‘দত্ত’ পদবি ব্যবহার করতেন নিজেদের সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। তবে তাতে সবটা যে রক্ষা হয় না, তা-ও বলেন ইয়াশিকা। সময়ে সময়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকেও। কোন দত্ত তাঁরা? পঞ্জাবি দত্ত না বাঙালি দত্ত? কোথায় বাড়ি? ইয়াশিকা বলেন, ‘‘যখন জানি যে মিথ্যে বলছি, তখন ভয়টা বেড়ে যায়। কী রকম ভয় ভয়ে উত্তর দিতাম যেন এ সব প্রশ্নের। আর মুখ দেখেই লোকে বুঝতেন, কোনও সমস্যা আছে।’’

এই ভার আর সামলে চলতে পারেননি তিনি রোহিত ভেমুলার ঘটনার পরে। তত দিনে তিনি দেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে চলে গিয়েছেন। কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে মিশে। দেখে ফেলেছেন, নিজেদের সম্মান রক্ষা করার আরও কত রকমের লড়াই হয়। তার পরেই মনস্থির করেন, আর নয়। নিজেকে লুকিয়ে, ভয় নিয়ে বাঁচবেন না তিনি। প্রথম পোস্টটা লেখেন সমাজমাধ্যমে। পরিচিত অনেকেই হইহই করেন। কেউ কেউ আবার ভাল ভাবে নেনও না। তবে তিনি থেমে থাকেননি।

আর বাবা-মা? চিন্তায় পড়েননি তাঁরা? ইয়াশিকা একটু থমকান। বলেন, ‘‘ভাল প্রশ্ন। তবে দূরত্বটা সাহায্য করেছে সকলকেই। নিউ ইয়র্ক থেকে মাকে ফোন করে এক দিন বললাম, মা আমি সকলকে জানিয়ে দিয়েছি যে আমরা দলিত।’’ মা কী করলেন? কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত কণ্ঠে নিজের সন্তানকে এগিয়ে চলার সাহস দিয়েছিলেন সেই মা। বলেছিলেন, ‘জিতে রহো বচ্চি।’

তবে ইয়াশিকা শুধু নিজেকেই দলিত বলে পরিচয় দেন। তাঁর ভাই-বোন-বাবা-মা আর পরিবারের সকলের পরিচয়ই গোপন রেখেছেন। মনে করেন, তাঁদের নিজেদের যখন ভয় কাটবে, তখনই তাঁরা বেরোতে পারবেন ভুয়ো পরিচয় রক্ষার খোলস থেকে। সেই দিনটার অপেক্ষায় আছেন তিনি। আশা, তাঁর লেখা আরও অনেককেই সেই সাহস দেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন