সচেতনতা বাড়লেও অঙ্গদানে ব্যতিক্রমী ভাবনা-হিমাংশুরা 

চিকিৎসকদের মতে, অঙ্গদান নিয়ে আগের ভুল ধারণা এখন অনেকটাই কমেছে। লোকে স্বেচ্ছায় অঙ্গদানে উৎসাহ দেখাচ্ছেন।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১০
Share:

এমসে অঙ্গদান নিয়ে মিলন সভায় দুই মেয়ে মেহের ও অনীতার সঙ্গে গুরবেন্দ্র সিংহের স্ত্রী গুরপ্রীত। পাশে পরিবারের অন্যেরা। —নিজস্ব চিত্র।

সাত বছরের মেহের জানে, বাবা মারা গিয়েছেন চার বছর আগেই। কিন্তু মেহের এ-ও জানে, তার বাবা এখনও বেঁচে। অন্য কারও বুকে, অন্য কারও চোখে।

Advertisement

অঙ্গদান! যা মেহেরের বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আরও চার জনের মধ্যে। দেরিতে হলেও যা নিয়ে ক্রমশ সচেতনতা বাড়ছে এ দেশে। আগের তুলনায় বেড়েছে অঙ্গদানের সংখ্যাও। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় বড়ই কম। মেহেরের বাবা গুরবেন্দ্র সিংহ এমনই একজন। পেশায় ব্যবসায়ী হয়েও আদ্যন্ত সমাজসেবী গুরবেন্দ্র চক্ষুদানের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন পরিবারকে। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত গুরবেন্দ্রর ‘ব্রেন ডেথ’-এর কথা চিকিৎসকেরা জানাতেই চোখ-সহ অন্যান্য অঙ্গদান করতে রাজি হয়ে যান স্ত্রী হরপ্রীত। চোখ, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি ও টিসু সংগ্রহ করে তা প্রতিস্থাপিত করা হয় অন্যদের দেহে। এমসে দিন কয়েক আগে এ ধরনের দাতা-গ্রহীতাদের একটি মিলন সভায় উপস্থিত ছিল গুরবেন্দ্রর গোটা পরিবার। দুই মেয়ে— সাত বছরের মেহের ও দশ বছরের অনিতাকে পাশে নিয়ে হরপ্রীত বলেন, ‘‘আমার স্বামী মারা গিয়েও বেঁচে রয়েছেন। অন্য কোথাও, অন্যখানে।’’

অনেকেই স্বেচ্ছায় অঙ্গদানে রাজি হন। অনেকে আবার প্রিয়জন যাতে অন্যের শরীরে বেঁচে থাকেন, সেই আশায় নিজেরাই উদ্যোগী হন। দিল্লির জনকপুরির চন্দন দাসের বোন ভাবনা দাস সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। পরে ‘ব্রেন ডেথ’ হয় তাঁর। এমস-এর অর্গান রিট্রিভাল ব্যাঙ্কিং অর্গানাইজেশন (ওআরবিও)-সদস্যরা চন্দনকে বোঝান, বোনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ভাবনার অধিকাংশ অঙ্গ সঠিক ভাবে কাজ করছে। যা বাঁচাতে পারে অনেকগুলি প্রাণ। চন্দন রাজি হলেও শুরুতে গররাজি ছিলেন ভাবনার বাবা। চন্দন বলেন, ‘‘বাবাকে বোঝাই, আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বোনের অঙ্গদানে অন্তত কয়েকটি পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে।’’ শেষ পর্যন্ত ভাবনার হৃদপিণ্ড, কিডনি, যকৃত হাসি ফুটিয়েছে অন্তত তিনটি পরিবারে মুখে। সময় পেলেই রক্তদান করতেন তেইশ বছরের হিমাংশু। ছাদ থেকে পড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। তাঁর বাবা বেদ প্রকাশ জানান, পরোপকার করা ছিল হিংমাশুর ধ্যানজ্ঞান। তাই তাঁর অঙ্গগুলিকে ছাই হতে দিইনি। আমার ছেলের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়ে অন্তত তিন থেকে চার জনের জীবন বাঁচিয়েছে।’’

Advertisement

কিন্তু ভারতের মতো দেশে সিন্ধুপ্রমাণ চাহিদার তুলনায় এ যেন বিন্দুর সমান। ভাবনা-হিমাংশু-গুরবেন্দ্রর পরিবার তাই ব্যতিক্রম এ দেশে। গত বছরের সমীক্ষা বলছে, ভারতে প্রতি ১০ হাজার লোকের মধ্যে অঙ্গদান করেছেন মাত্র ৬৫ জন। ওআরবিও-র পক্ষে চিকিৎসক আরতি ভিজ বলেন, ‘‘গোটা দেশে ফি বছর প্রায় ২ লক্ষ কিডনির প্রয়োজন হয়। স্বেচ্ছায় পাওয়া যায় খুব বেশি হলে আট হাজার। যকৃৎ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন গড়ে আশি হাজার রুগি। পাওয়া যায় মাত্র দু’হাজার।’’ এমস-এর চিকিৎসকদের মতে, গোটা বিষয়টি নিয়ে বিপুল সচেতনতা প্রয়োজন। কার্যত মিশন মোডে এ নিয়ে প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। রয়েছে অঙ্গদান নিয়ে নানাবিধ ভুল ধারণা দূর করতে জনসচেতনা বৃদ্ধির প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির মৃত্যু রাজস্থানে, সরকারের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ

চিকিৎসকদের মতে, অঙ্গদান নিয়ে আগের ভুল ধারণা এখন অনেকটাই কমেছে। লোকে স্বেচ্ছায় অঙ্গদানে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আলোচনাসভায় উপস্থিত অমিতা ও মনোজ শেঠী জানালেন, ‘‘আমার মা স্বাধীনতা সংগ্রামীর মেয়ে। দেশের জন্য মা সারা জীবন কিছু করতে চেয়েছেন। মৃত্যুর আগে অঙ্গদানের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। যা সন্তান হিসেবে আমরা পালন করেছি।’’ আরতি ভিজ বলছেন, অনেকেই অঙ্গদান করতে ইচ্ছুক থাকেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে নিকটজনেরা মৃতের শরীর নিয়ে কাঁটাছেড়া করতে রাজি হন না। তাই মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছানুযায়ী যাতে অঙ্গদান নিশ্চিত হয়, সেটা দেখা পরিবারের কর্তব্য বলেই মত চিকিৎসকদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন