প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি।
নরেন্দ্র মোদী ও নওয়াজ শরিফের গত কালের বৈঠককে দেশে ফিরে আজ এ ভাবেই ব্যাখ্যা করলেন পাক প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী তথা নিরাপত্তা ও বিদেশ সংক্রান্ত উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ। তিনি জানান, সংঘাতকে সমন্বয়ে বদলে ফেলার ব্যাপারে দু’দেশই একমত হয়েছে। এর পর বিদেশসচিবেরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
কাজেই ভারত-পাক সম্পর্ক এ বার আরও কিছুটা গতি পেল বলে মনে করছে সাউথ ব্লক। শপথ নেওয়ার আগেই পাক প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে সেই সম্পর্কের পথ অনেকটাই বেঁধে দিয়েছিলেন মোদী। নওয়াজও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এসেছিলেন। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নওয়াজের এই সফরে সন্ত্রাসের জেরে থমকে থাকা আলোচনা শুধু যে ফের শুরু করা সম্ভব হল তা-ই নয়, ভবিষ্যতের রাস্তাও খোলা রাখা গেল। সূত্রের খবর, বৈঠকে নওয়াজ প্রস্তাব দিয়েছেন, সীমান্ত নিয়ে প্রতিবন্ধকতাকে এক পাশে রেখে ভারত এবং পাকিস্তান বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিস্তার ঘটাক। এবং সেই প্রস্তাব ইতিবাচক ভাবেই দেখার আশ্বাস দিয়েছেন মোদী।
সম্পর্কের নতুন মোড়ের আভাস এখানেই। অতীতে ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ বৈঠকের টেবিল বারবার অগ্নিগর্ভ হয়েছে ‘কে-ওয়ার্ড’ বা কাশ্মীর নিয়ে। আলোচনা ভেস্তেও দিয়েছে সন্ত্রাসবাদ। আইএসআই এবং পাক সেনার চাপে গণতান্ত্রিক ভাবে জিতে আসা জারদারি সরকারকেও বারবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলে দিল্লিকে চাপে রাখতে হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বিবৃতিতেও রাখতে হয়েছে কাশ্মীর প্রসঙ্গ। কিন্তু এই প্রথম বার, নয়াদিল্লি ছাড়ার আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দিলেন, যেখানে ভারতের সঙ্গে সংঘাতমূলক একটি বাক্যও নেই। বরং সংঘাতকে অতিক্রম করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানো নিয়েই তিনি সক্রিয়তা দেখালেন বেশি। পাশাপাশি, হুরিয়ত নেতৃত্বের সঙ্গে নওয়াজের দেখা না করার বিষয়টিও তাঁর তরফে আর এক দফা ইতিবাচক সঙ্কেত বলে মনে করছে সাউথ ব্লক।
রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজন হয়েছিল নৈশভোজ।
তাতেই যোগ দিতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী, প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং লালকৃষ্ণ আডবাণী। বুধবার। ছবি: পিটিআই।
এই মনোভাব বদল নিয়ে অবশ্য নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশের তোপের মুখে পড়েছেন নওয়াজ। শীর্ষ বৈঠকে সন্ত্রাস-প্রসঙ্গ উঠলেও কাশ্মীর নিয়ে সে ভাবে কথা হয়নি বলে দাবি করেছে তারা। ‘শুধু ছবি তুলিয়ে কী হবে?’ বা ‘মোদী সেই ২৬/১১-য়’ আটকে থাকবেন জাতীয় সম্পাদকীয়ও লিখেছে বিভিন্ন সংবাদপত্র। এ প্রসঙ্গে সরতাজের অবশ্য দাবি, বিতর্কিত সমস্ত বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে। “কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অসম্ভব” বলেছেন তিনি। যদিও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ তাঁর এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবেই দেখছেন।
বস্তুত, নওয়াজ সরকারও জানে মোদী বা বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে সেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণেই প্রকাশ্যে সন্ত্রাস নিয়ে কড়া শব্দ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু তাতে শান্তি আলোচনায় বাধা পড়বে বলে তারা মনে করছে না। সন্ত্রাসে পাক ভূখণ্ড ব্যবহৃত হওয়া বন্ধ করা এবং ২৬/১১-র পাণ্ডাদের সাজার দাবি গত কালের বৈঠকে তোলেন মোদী। সুষমাও আজ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে বলেন, “আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চাই। কিন্তু গোলাগুলির আওয়াজ চললে কথাবার্তার শব্দ থেমে যায়।” কিন্তু পাক-সূত্রে আজ বলা হয়েছে যে, মোদী সন্ত্রাস প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা ‘নতুন কিছু নয়’। সরতাজের কথায়, “সন্ত্রাসবাদ যে দু’দেশেরই উদ্বেগের কারণ এবং পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে তা যে নির্মূল করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে দুই প্রতিবেশী দেশই একমত হয়েছে।”
আরও একটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাইছে নয়াদিল্লি। সেটি হল, নওয়াজের ভারত সফরকে জারদারি জমানার বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার-এর স্বাগত জানানো। হিনা বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বের ভূমিকা বড় হয়। মোদীর উষ্ণ আমন্ত্রণ এখানকার অনেক নেতিবাচক স্বরকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।” শুধু তা-ই নয়, নওয়াজের সুরেই হিনা বলেছেন, শান্তির পথ থেকে সরে আসার কোনও প্রশ্ন নেই। বাণিজ্যই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা এবং পারস্পরিক বিনিয়োগই শান্তির হাতকে শক্তিশালী করে। নয়াদিল্লি মনে করছে, হিনার এই মন্তব্যেই স্পষ্ট যে, ভারত সফরে আসার আগে রাজনৈতিক ভাবেও নিজের দেশে বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন নওয়াজ। সেই কারণেই বাণিজ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে মোদীকে সরাসরি আহ্বান জানানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।